তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: আগস্টের বর্তমান সময়টা চায়ের ভরা মৌসুম। কারণ এই মাসে উৎপাদন হয় পুরো মৌসুমের ২১ শতাংশ চা পাতা। মার্চের শেষে থেকে মূলত গাছে কুঁড়ি আসতে শুরু করে, যা নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বাগানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-আগস্ট সর্বোচ্চ চা উৎপাদন হয়। আগস্টের পর উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। গেল জুলাই মাসের শেষের দিকে এবং চলতি আগস্ট মাসের চাহিদামতো বৃষ্টির সুফল পেতে যাচ্ছে সিলেটের চা বাগানগুলো।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের তথ্য মতে, আগস্ট পর্যন্ত উৎপাদন ৫০ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে যাবে। অথচ ২০২২ সালের জুলাই মাসে উৎপাদন হয়েছিল ১১ দশমিক ২৭৬ মিলিয়ন কেজি। আর আগস্টে হয়েছিল ১০ দশমিক ৭৬২ মিলিয়ন কেজি।
বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ইসমাইল হোসেন জানান, এ মৌসুমে চায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০২ মিলিয়ন কেজি। জুন মাসের প্রথম দিকে চা শিল্প তাপাদাহের মধ্যে পড়ে। বৃষ্টিপাত কম হয়েছে।
একাধিক চা শ্রমিক জানান, এখন বেশি বেশি পাতা তুলছেন। হাজরি এখন দুইটা হয়। পাতা তুলেছেন ৬৩ কেজি। এখন প্রতিদিন ৬৫ থেকে ৭৫ কেজি পাতা তুলেন।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের রফিকুল হক বলেন, জুন পর্যন্ত মৌসুমের মোট উৎপাদন ২৬.৪৬২ মিলিয়ন কেজি। জুলাই থেকে আগস্টে কমপক্ষে ২৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হবে এবং আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০২ মিলিয়ন কেজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন এ কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে তারাপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, চলতি বছরের অর্ধেক সময় চা উৎপাদন নিয়ে আমরা শঙ্কায় ছিলাম। কারণ অনাবৃষ্টিতে চা গাছ মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তবে জুলাইয়ের শেষের দিকে এবং বর্তমান বৃষ্টি সিলেটের চা উৎপাদনে সুফল বয়ে এনেছে। ইতোমধ্যে উৎপাদন প্রায় লেভেলের কাছাকাছি। বাকী ২/৩ মাসের উৎপাদন এ মওসুমের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করছি।
জানা গেছে, চলতি বছরে মাত্রারিক্ত তাপমাত্রায় গরম ও খরা থাকার কারণে সিলেটের চা বাগান গুলোতে চা পাতা হলদে ও মরা গাছে পরিণত হয়েছিল। অতিরিক্ত খরায় কমে গিয়েছিলো চা উৎপাদন। এতে বাগান মালিকরা ভূগছিলেন হতাশায়। তবে মালিক পক্ষের বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১০ কোটি কেজিরও বেশি ছিলো। কিন্তু ভরা মৌসুমে চায়ের উৎপাদন ছিল না। তীব্র খরায় বিগত বছরের চেয়েও উৎপাদন কমে এসেছিল অস্বাভাবিক হারে। তবে বর্ষা মৌসুমের শেষার্ধের ভারি বৃষ্টিপাত আশা জাগিয়েছে চা বাগান মালিকদের। পরিমিত ও নিয়মিত বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দেশে চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম শুরু হয় জুনে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের কারণে প্রাকৃতিক সেচ ব্যবস্থায় অধিক পরিমাণে গুণগত মানের চা উৎপাদন হয়। তবে এবার জুন পেরিয়ে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে চা উৎপাদন ছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কম। চলতি বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে আশানুরূপ বৃষ্টি না হওয়ায় তীব্র খরায় বাগান গুলোর উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। তবে সাম্প্রতিক বৃষ্টিপাতের ফলে উৎপাদনে আশারা আলো দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে টানা পাঁচটি সাপ্তাহিক নিলামে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি চা সরবরাহ করেছে বাগানগুলো।
বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত না হওয়ার প্রভাব পড়ে ১৯ জুন অনুষ্ঠিত নবম চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক নিলামে। এরপর প্রায় এক মাস অর্থাৎ টানা ১২তম নিলাম পর্যন্ত আগের বছরের চেয়ে কম চা পাঠিয়েছে বাগানগুলো। তবে ১৩তম আন্তর্জাতিক নিলামে অবস্থার পরিবর্তন হয়। ১৩তম নিলাম থেকে সর্বশেষ ১৬তম নিলাম পর্যন্ত টানা পাঁচটি নিলামে বাড়তি চা পাঠিয়েছে বাগানগুলো। দুই সপ্তাহ ধরে নিয়মিত ও পরিমিত বৃষ্টিপাত থাকায় আগামীতেও বাড়তি উৎপাদনের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চা নিলামকারী ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠান গুলো জানিয়েছে, সর্বশেষ পাঁচটি নিলামে ১ কোটি ৮৫ লাখ ৩৬ হাজার ৪০৪ কেজি চা বিক্রির জন্য তোলা হয়েছিল, যা পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৪ লাখ ৫ হাজার ২৭৬ কেজি বেশি। যদিও ৮ম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত চারটি নিলামে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৭৯ কেজি। আগের বছরের একই সময়ে চারটি নিলামে উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩২০ কেজি। অর্থাৎ বর্ষা মৌসুম শুরুর চার নিলামে আগের বছরের চেয়ে ১২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৪১ কেজি চা কম উৎপাদন হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার চায়ের ফলন কমলেও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে। বিগত বছর গুলোয় প্রতি কেজি চায়ের দাম ২০০ টাকার কম থাকলেও এবার দীর্ঘ সময় ধরে ২০০ টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে। ১৩তম নিলামে মৌসুমের সর্বোচ্চ দাম অর্থাৎ কেজি প্রতি ২২৩ টাকা ৪১ পয়সা গড় দামে চা কিনেছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশে বর্তমানে চায়ের বার্ষিক চাহিদা প্রায় সাড়ে ৯ কোটি কেজি। ২০২২ সালে ১০ কোটি কেজি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও উৎপাদন হয়েছিল ৯ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার কেজি। চলতি বছর লক্ষ্য মাত্রা ১০ কোটি ২০ লাখ কেজিতে উন্নীত হলেও জুন পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৬৪ লাখ ৪২ হাজার কেজি। সাম্প্রতিক উৎপাদনের ধারা অব্যাহত থাকলে বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব বলে মনে করছে চা বোর্ড ও বাগান মালিকরা।