করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, সরকার এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে করোনার ভ্যাকসিনের আগাম অর্ডার দিয়েছে। যখনই এটা কার্যকর হবে, তখনই এটা যেন বাংলাদেশের মানুষ পায়, আমরা সেই ব্যবস্থা নিয়েছি। একটা সময় দেখা যেত, একটু হাঁচি হলেও অনেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ চলে যেতেন; কিন্তু করোনা বুঝিয়ে দিয়ে গেল টাকাপয়সা, ধনসম্পদের কোনো মূল্য নেই। মনে হয়, করোনাভাইরাস এসেছে মানুষকে শিক্ষা দিতে। আর করোনাভাইরাস আমাদের শিখিয়েছে-দেশেই চিকিৎসাসেবা নেয়া সম্ভব।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তিনি এ কথা বলেন। এদিকে এদিন রাতে সংসদে দেয়া এক ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী করোনার সংক্রমণ মোকাবেলায় সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ, বিশেষ করে ভ্যাকসিনের জন্য বুকিংয়ের কথা উল্লেখ করেন। এ ছাড়া তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে স্কুল না খোলার পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেন। এদিন ইতালির রাজধানী রোমে আয়োজিত ইউএনএফসিসিসি ‘রেস টু জিরো ডায়ালগের’ সমাপ্তি অধিবেশনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত সংকট থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ বৈশ্বিক পদক্ষেপের আহ্বান জানান।
দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন আমরা দেখলাম এরকম একটা জিনিস আসতে পারে, তখন আমরা আগাম বাজেট করি। আমরা জানি যে, সামনে আরও একটি ধাক্কা আসছে। ইতোমধ্যে অনেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং সেটা ছড়াচ্ছে। তাই সবাইকে একটু স্বাস্থ্যসুরক্ষাবিধি মেনে চলতে হবে। ভ্যাকসিন আবিষ্কার হচ্ছে। সেটা নিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে। আমরা প্রায় এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে ভ্যাকসিন বুক করে ফেলেছি। যখনই এটা কার্যকর হবে, তখনই যেন বাংলাদেশের মানুষ পায়, আমরা সেই ব্যবস্থা নিয়েছি এবং সেটা চলমান থাকবে। আমি এখন ঘরের মধ্যে একা, তাই মাস্ক পরছি না। কিন্তু লোকজন এলেই মাস্ক পরি। লোকজনের সামনে এলেই মাস্ক পরতে হবে।
করোনা মোকাবেলায় সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসে যখন সারা বিশ্ব স্থবির; যখন অনেক উন্নত দেশ এটাকে সামাল দিতে পারছিল না, তখনও বাংলাদেশের অর্থনীতি কিন্তু আমরা থেমে যেতে দিইনি। এটা কেন পেরেছি? আমি জানি, বিপদ এলে নার্ভাস হয়ে যেতে নেই। বিপদটাকে কীভাবে মোকাবেলা করব, সেদিকেই লক্ষ রাখতে হবে, আর সেভাবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা সেই কাজটিই করছি।
আওয়ামী লীগই আমার পরিবার : করোনাভাইরাসের কারণে গণভবনে ‘কারাবন্দির’ মতো জীবন অতিবাহিত করছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আমি একা। জেলখানার মতোই আছি। সেটাই আমার দুঃখ। ২০০৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছিলাম ছোট জেলে, এখন বড় জেলে আছি। করোনা পরিস্থিতিতে বন্দির মতো থাকলেও সব কাজ করে যাচ্ছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যখনই সভা করবেন বা কথা বলবেন, আমাকে লিংক দেবেন। আমি যোগাযোগ করতে পারব। ভিডিও কলে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করতে চান জানিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগই তো আমার পরিবার।
বয়স ৭৪ বছর পার হয়ে গেছে, এটা মনে রাখতে হবে : দলের নেতাকর্মীদের নিজের বয়সের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমি আবারও বলব, চিরদিন কেউ বেঁচে থাকে না। আমিও থাকব না। কারণ, আমারও তো বয়স হয়েছে। ৭৪ বছর পার হয়ে গেছে। এটা মনে রাখতে হবে। এ বয়স অনেক বেশি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের লংজিভিটি আমরা বাড়িয়ে ৭২ বছরে এনেছি। তারপরও তার থেকে বেশিই আছে। তারপরও প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ, জন্মালে তো মরতেই হবে-এটা ঠিক। কিন্তু সংগঠনটাকে তো আমি চেষ্টা করেছি, আমার মতো গুছিয়ে দিতে। সেই ক্ষেত্রে আমি বলব, আমাদের সহযোগী সংগঠন যে কটা আছে, খুব দ্রুত একেবারে তূণমূল পর্যায় থেকে আপনাদের সম্মেলনগুলো করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমি নিজের দিকে তাকাই না। নিজে কী পাব, সেটা দেখিনি। ছেলে-মেয়েগুলোকে আমি আর রেহানা; আমাদের দু’জনের কথা ছিল লেখাপড়া শেখো, এর বেশি আর কোনো সম্পদ দিতে পারব না। আমরা ঠিক সেটুকুই করেছি। তারপরও লেখাপড়া শেখা, সেটাও তারা নিজেরাই করেছে। চাকরি করে, লোন নিয়ে। মিশনারি স্কুলে সপ্তাহে একদিন হয়তো মাংস দিত। আর সারা সপ্তাহ এই ডাল-ভাত খেতে হয়েছে। জয়, পুতুল এইভাবেই মানুষ হয়েছে। তারা তো এই বাংলাদেশটাকেও কিছু দিয়েছে। নিজেরা তো চায়নি, কার জন্য করেছে? দেশের মানুষের জন্য করেছে? কেন করেছে? মানুষকে আমার বাবা ভালোবেসেছেন, তাদের জন্য জীবন দিয়ে গেছেন। সেই মানুষগুলো যেন ভালো থাকে, আমরা সেটাই চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরাই দেশকে ডিজিটাল করে দিয়েছি। অনেক টেলিভিশন দিয়ে দিয়েছি। মোবাইল ফোন দিয়েছি হাতে। আমাদের শহরে একদল লোক আছে, সবাই বসে বসে আমাদেরই দেয়া জিনিস ব্যবহার করে আরামে আমাদেরই সমালোচনা করে। এটা হল না, ওটা হল না। কেউ বলছে, গণতন্ত্রই নাই। আমার মাঝে মাঝে তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে-গণতন্ত্র এখন নাই! তার মানে জিয়াউর রহমান যখন মার্শাল ল দিয়ে ওই হত্যা ক্যু ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করেছিল, তখন গণতন্ত্র ছিল? বা খালেদা জিয়া যখন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে ভোট চুরি করে ক্ষমতায় গেল! ওটা গণতন্ত্র!
তিনি আরও বলেন, এখন যে নির্বাচনগুলো হচ্ছে, উপনির্বাচনে তারা নামকাওয়াস্তে তারা ক্যান্ডিডেট দেন? খুব হইচই করে, তারপর ইলেকশনের দিন দুপুরবেলা পার হতে পারে না তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। আমি বলব, এটা তাদের পরিকল্পিত খেলা, প্ল্যানড গেম। এটা এখন আমরা জানি। তারা এটাই করবে, কারণ তাদের লক্ষ্য নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। মানে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা! তারা তো নিজেরাই স্বীকার করছে, তারাই আগুন (বাসে) দিয়েছে। কিন্তু তারা আগুন দেবে আর তারা বলছে, সরকারি দল। সরকারি দল কেন করবে? ঠিক ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে যখন আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হল? তখন কী অপপ্রচার চলেছিল, নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। বলেছিল, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে মেরেছে! এইভাবে তারা মিথ্যাচার করে। আমার মনে হয়, দেশবাসীকেও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, আর আমাদের যারা সমালোচনা করেন, আমি বলি সমালোচনা করেন। আমাদের ক্ষতি নাই, সমালোচনা ভালো? সমালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারি, কোথায় কোনো ত্রুটি আছে কি না? কিন্তু মিথ্যা অপপ্রচার করা, মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং সব থেকে দুর্ভাগ্য হল শুধু দেশেই নয়, বিদেশিদের কাছে গেয়েও মিথ্যা অপপ্রচার করা হয়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বদনাম করে আসা হয়। এটাই হচ্ছে দুভার্গ্যরে।
দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগকে একটা আদর্শ নিয়ে চলতে হবে। সংগঠনগুলোকে এটি চিন্তা করতে হবে, আমাদের একটা দায়িত্ব আছে এ দেশের মানুষের প্রতি।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে সম্পাদকমণ্ডলীর সভা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হলে তাকে সভার এজেন্ডাগুলো সম্পর্কে অবহিত করেন ওবায়দুল কাদের। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, এসএম কামাল হোসেন, মির্জা আজম, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, শ্রম সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ, অর্থ সম্পাদক ওয়াসিকা আয়েশা খান, স্বাস্থ্য সম্পাদক রোকেয়া সুলতানা, আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান, উপদফতর সম্পাদক সায়েম খান, কেন্দ্রীয় সদস্য অ্যাডভোকেট এবিএম রিয়াজুল কবীর কাওছার প্রমুখ।
স্কুল খুলে বাচ্চাদের মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলতে পারি না : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশন ও সংসদের দশম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্কুল খোলার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমেরিকাসহ বিভিন্ন স্থানে স্কুল খুলে তারা আবার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। আমরা স্কুল খোলার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম; কিন্তু করোনার সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হওয়ায় ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় স্কুল খুলে বাচ্চাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারি না। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এর আগে বিরোধী দলের উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার যৌক্তিতা নেই মন্তব্য করে তা খুলে দেয়ার প্রস্তাব করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাচ্চাদের খুব কষ্ট হচ্ছে-এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও তাদের তো মৃত্যুর ঝুঁকিতে ঠেলে দিতে পারি না। করোনাভাইরাস এটা একটা সংক্রামক ব্যাধি। এখনও এটার চিকিৎসা বের হয়নি, তারপরও আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি-মানুষ ভালো হচ্ছে। সেখানে এই ঝুঁকিটা আমরা ছেলেমেয়েদের জন্য কেন নেব? তিনি বলেন, অটো-প্রমোশনের ব্যাপারে বলব। আমাদের আগে তো এই সেমিস্টার ব্যবস্থা ছিল না, আমি প্রথমবার সরকারে এসে সেমিস্টার সিস্টেম চালু করি। কাজেই সেখানে সারা বছর তারা যে পরীক্ষা দিয়েছে, তারই ভিত্তিতে একটা রেজাল্ট দেয়া-এটা কিন্তু ইংল্যান্ডেও দিয়েছে। এটা পৃথিবীর অনেক দেশেই দিয়েছে। এতে খুব বেশি একটা ক্ষতি হয়, তা না। তারা তারপর তো স্কুল করবে, পড়বে, পরীক্ষা দেবে। যারা টিকে থাকবে থাকবে, না হলে আবার পরীক্ষা দেবে। সেই সুযোগটা তাদের আছে। কাজেই অটো-প্রমোশনে খুব ক্ষতি হয়ে গেল-এটা কিন্তু ঠিক না।
সংকট থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে আশু বৈশ্বিক পদক্ষেপ জরুরি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত সংকট থেকে ধরিত্রীকে বাঁচাতে একটি আশু ঐক্যবদ্ধ বৈশ্বিক প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে এ শতাব্দীর শেষের দিকে তাপমাত্রা ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি বাড়তে পারে এবং তাৎক্ষণিক প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে পৃথিবী বেঁচে থাকার পক্ষে পুরোপুরি অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে।’
ইউএনএফসিসিসি ‘রেস টু জিরো ডায়ালগের’ সমাপ্তি অধিবেশনে দেয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। ইতালির রাজধানী রোমে আয়োজিত ডায়ালগে প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।