‘জুমার নামাজের বিশাল জামায়াতের নেতৃত্বে আমি, পিছনে কাতারে মন্ত্রী, এমপি, গণ্যমান্যসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মুসল্লি। তারা আরব, বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি আরও অনেক দেশের। প্রবাসে ইমামতির সম্মান-গর্বের সেই উজ্জ্বল দিনের কথা মনে পড়লে মন গুমড়ে ওঠে, যখন হারাতে হলো সেই মর্যাদা।’
কষ্ট নিয়ে সোনালী দিনের এমন স্মৃতিচারণ করছিলেন বাহরাইনে ২১ বছরের প্রবাস জীবন ছেড়ে দেশে ফিরে আসা বাংলাদেশি খতিব কক্সবাজারের শায়েখ হারুন আজিজী নাদভীর।
১৯৯৮ সালে তিনি বাহরাইন যান। দীর্ঘদিন তিনি দেশটির বারবার এলাকার আবদুল্লাহ এতিম মসজিদের খতিব ছিলেন। দেড় বছর আগে মর্যাদাপূর্ণ এই পেশাটি ছেড়ে পরিবার নিয়ে তাকে ফিরতে হয় দেশে। ‘ভালো বেতন, মর্যাদাপূর্ণ চাকরি আর নিরাপদ প্রবাস জীবন ছেড়ে আসাটা অনেক কষ্টের। কিন্তু তারচেয়েও বেশি সমস্যায় পড়েছি সন্তানদের নিয়ে। আমার পাঁচ সন্তানের জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা সবই বাহরাইনে। মাঝপথে দেশে এসে এখানকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। সবাই পড়তো ইংরেজি মাধ্যমে। দেশে এসে এখনও সমমানের কোথাও ভর্তি করাতে পারিনি। তাদের অনিশ্চিত শিক্ষাজীবন নিয়েই দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে এখন,’ বলেন এই খতিব।
তিন বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি নির্মম হত্যাকাণ্ডের জেরে তার মতো বাহরাইনফেরত ২৫০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি ইমাম-মুয়াজ্জিনের জীবনযাত্রা এখন এমনই কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি। দেশে ফেরার পর তাদের বেশিরভাগই এখনও কর্মহীন। বাহরাইনে এখনও কর্মরত আরও ৫৪ ইমাম-মুয়াজ্জিনের দিন কাটছে ফেরার আতংক আর অপেক্ষায়।
২০১৮ সালের ৫ আগস্ট বাহরাইনের মোহাররক এলাকায় সিদা মসজিদের বাংলাদেশি মুয়াজ্জিন কামাল উদ্দিন নৃশংসভাবে হত্যা করেন বাহরাইনি ইমাম আবদুল জলিল হামদকে। মসজিদের ভেতরেই তাকে হত্যা করার পর মরদেহ তিন টুকরো করে বস্তায় করে দূরের এক ইয়ার্ডের পাশে ফেলে দেওয়া হয়। ফেলার সময় দুই শ্রমিকের সন্দেহে ধরা পড়ে যান কামাল উদ্দিন। খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধারের পর ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ কামাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে। বিচারে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয় তার। ২০১৯ সালের ২৭ জুলাই প্রকাশ্যে গুলি করে কামাল উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়।
বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি আসিফ আহমেদ বলেন, ‘এই নৃশংস ঘটনা বাহরাইনি সমাজকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। সংসদে তুমুল সমালোচনা, ধিক্কার জানানো হয়েছিল। বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশিরা হয়েছিলেন লজ্জিত, শঙ্কিত। ঘটনার জেরে তখন থেকেই বাংলাদেশি ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের দেশে ফেরত পাঠানো শুরু হয়। এর থেকেও কঠোর সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি, যা আজও খোলেনি।’
প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানান, ১৯৮০ সাল থেকে বাহরাইনে সুনামের সঙ্গে চাকরি করে আসছেন ইমাম-মুয়াজ্জিনরা। ২০১৮ সালের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন মসজিদে ৩০০ জনেরও বেশি ইমাম-মুয়াজ্জিন ছিলেন। ৮৫ শতাংশ মসজিদেই ছিলেন বাংলাদেশি মুয়াজ্জিন। দুই লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের এই সংখ্যা কম হলেও মর্যাদায় তারা ছিলেন সবার উপরে।
ইমাম-মুয়াজ্জিনদের আকর্ষণীয় বেতন, পরিবারসহ আবাসন ছাড়াও নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয় বাহরাইন সরকার। ৪৫ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখেরও বেশি পর্যন্ত ছিল তাদের বেতন। দ্বীনি শিক্ষাসহ নানা ধর্মীয় আয়োজন থেকে তাদের বাড়তি আয়ও ছিল। সন্তানদের উন্নত ও উচ্চশিক্ষা দেওয়ার ভালো সুযোগও পেয়েছিলেন তারা। বাংলাদেশ দূতাবাস ও সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, ধাপে ধাপে বেশিরভাগ ইমাম-মুয়াজ্জিনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকি ৫৪ জনের মধ্যে ২৫ জনকে চলতি মাসের শুরুতে ফেরত পাঠানোর সব প্রস্তুতি নেয় নিয়োগদাতা ‘সুন্নি ওয়াকফ। তবে বাংলাদেশে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি স্থগিত হয়ে যায়। চলাচল স্বাভাবিক হলে তারা দেশে ফিরে আসবেন। এরপর বাকিরাও ফিরে এলে বাহরাইনে বাংলাদেশি ইমাম-মুয়াজ্জিন শূন্যের কোটায় নামবে।
বাংলাদেশিদের এই পদগুলোতে এখন নিয়োগ পাচ্ছেন ইয়েমেনি, পাকিস্তানি, ভারতীয়সহ নানা দেশের ইমাম-মুয়াজ্জিন। ফেরার অপেক্ষায় থাকা ইমাম-মুয়াজ্জিনরা শেষবারের মতো কূটনৈতিক চেষ্টা চালাতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে আর্জি জানিয়েছে।
তারা বলছেন, মূল অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে। এতে তারাও সন্তুষ্ট। বেশিরভাগ ইমাম-মুয়াজ্জিনকে দেশে ফেরত পাঠানোর মতো বড় শাস্তিও দেওয়া হয়েছে। এখন সামান্য যে কয়েকজন আছে, তাদের ওপর বাহরাইন সরকার যেন সদয় হয়।
এই দলের সমন্বয়ক হাফেজ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের করোনাকালে মানবিক বিবেচনায় থাকার সুযোগ দেওয়ার আর্জি জানাচ্ছি। না হলে বড় ক্ষতিতে পড়তে হবে। প্রতিজ্ঞা করছি, ভবিষ্যতে আমাদের দ্বারা কোনো ধরণের অপরাধ হবে না। যদি একজনের কাছেও ত্রুটি পায় তাহলে সবাইকে মুহূর্তের মধ্যে দেশে ফেরত পাঠাবে।’
‘শেষ পর্যন্ত তা যদি নাও হয় অন্তত এই বছরটা থাকার সুযোগ যেন দেওয়া হয়। সন্তানদের শিক্ষা বছরটা যেন শেষ করে যেতে পারি। তা না হলে তাদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে যাবে,’ বলেন রাজধানীর তুবলী মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ মো. শাহজালাল।
বাংলাদেশি কমিউনিটি সংগঠক ও ভুক্তভোগীরা জানান, ইমাম-মুয়াজ্জিনদের ফেরত ঠেকাতে বাহরাইন সরকারের নানা স্তরে যোগাযোগ করে অনেক চেষ্টা চালিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস। বাংলাদেশি শ্রমবাজার আবার খোলার মূল লক্ষ্যের সঙ্গে ইমাম-মুয়াজ্জিনের বিষয়টি নিয়ে চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না দূতাবাস কর্তৃপক্ষের, বিশেষ করে রাষ্ট্রদূতের।
দেশটি নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নিজেই অনেকবার পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়, অভিবাসন দপ্তর এবং সুন্নি ওয়াকফর সঙ্গে চিঠি, ফোনালাপ, ওয়েবিনারের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছি। সিদ্ধান্তটি একেবারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বলে পুনর্বিবেচনা তাদের এখতিয়ারে নেই বলে আমাদের জানানো হয়েছে।’
রাষ্ট্রদূতের মতে, ইমাম হত্যার ঘটনাটি এতটাই নির্মম ছিল যে তা থেকে মন সড়াতে পারছে না বাহরাইনি সমাজ ও সরকার। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি বাহরাইন সরকারের আন্তরিকতায় কাগজপত্রহীন ৪০ হাজার বাংলাদেশি কর্মীকে বৈধ হওয়ার সুযোগ আমরা পেয়েছি। এরই মধ্যে ২৫ হাজারেরও বেশি কর্মী বৈধ হয়েছেন। এটিও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনাকালে নানা ধরণের সহায়তা-সমর্থনও পাচ্ছি আমরা। কিন্তু ইমাম-মুয়াজ্জিনের বিষয়ে তাদের অনীহার পেছনে সেই বেদনাদায়ক মনোভাবই কারণ বলে মনে করি এবং সেটা হওয়াটাও স্বাভাবিক। তবুও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব। সর্বশেষ দলটির আর্জির বিষয়ে আবারও যোগাযোগ করছি।’
বিরূপ প্রভাবের মাঝেও অনেক মসজিদ কর্তৃপক্ষের বাংলাদেশিদের প্রতি সহানুভূতি ও আস্থা এখনও আছে জানিয়ে দেশে ফেরত আসা মুয়াজ্জিন কুমিল্লার মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা আমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। বাহরাইনি ইমাম সাহেবও আমাকে তেমনই স্নেহ করতেন। তারা নিয়মিত খোঁজ খবর নেন। ভিসা দেওয়া শুরু হলেই আবার আমাকে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন।’ বাহরাইনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সন্তানদের দ্বীনি শিক্ষার একমাত্র ভরসা ছিল বাংলাদেশি ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা। হঠাৎ তাদের অনুপস্থিতিতে সমস্যায় পড়েছেন প্রবাসীরা।
সাংবাদিক বশির আহমেদ বলেন, ‘আমার দুই ছেলেকে বাসার পাশের মসজিদের একজন বাংলাদেশি মুয়াজ্জিন আরবি পড়াতেন। তিনি চলে যাওয়াতে খুব সমস্যায় পড়েছি। বেশিরভাগ বাংলাদেশি অভিভাবকরাও এমন সমস্যায় আছেন। ভাষাগত ও বেশি বেতনের কারণে অন্য দেশের ইমাম ও মুয়াজ্জিন দিয়ে পড়ানোও সম্ভব হচ্ছে না।’
এজাজ মাহমুদ: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক