কুয়েতে মানবপাচারের দায়ে আটক বাংলাদেশি এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের কোম্পানী একাউন্টের মূলধন ৩ মিলিয়নসহ তার হিসাবে থাকা মোট ৫ মিলিয়ন দিনার জব্দ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে পাবলিক প্রসিকিউশন কুয়েতের সেন্ট্রাল ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে। মানবপাচার, ভিসা বাণিজ্য, মানি লন্ডারিংসহ সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে চলমান মামলা আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে না হওয়া পর্যন্ত একটি দিনারও যেনো পাপুল বা তার সহযোগীরা ব্যাংক থেকে উত্তোলন বা সরাতে না পারেন তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, লক্ষীপুর-২ আসনের এমপি পাপুলের স্বীকারোক্তি মতে তার অপকর্মের একের পর এক সহযোগী ধরা পড়ছেন। সর্বশেষ ধরা পড়া দেশটির স্বরাষ্ট্র ও জনশক্তি বিভাগের ৩ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাকে শনিবার আদালতে জেরা করা হয়েছে।
তাদের বক্তব্য বা জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছেন। পৃথক রিপোর্টে আরব টাইমস এ খবর দিয়েছে। তবে ওই কর্মকর্তাত্রয়ের বিস্তারিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় নি।
পাপুলকাণ্ড নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে রিপোর্ট করছে ইংরেজি দৈনিক আরব টাইমস এবং আরবি দৈনিক আল-কাবাস। শুক্রবার তাদের ফলোআপ রিপোর্টে বলা হয়েছিল ঘুষ প্রদানের কৌশল বাতলে দেয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত কুয়েতের একজন সামরিক অফিসারসহ ৩ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে আদালতে তলব করা হয়েছে। তাদেরকে আদালতে উপস্থাপনের আদেশ পেয়েছে সিআইডি। পাপুলকাণ্ডের উন্মোচনকারী আল কাবাসের রিপোর্টে বাড়তি তথ্য ছিল পাপুলের সহযোগী স্বরাষ্ট্রে কর্মরত কর্ণেল, জনশক্তি ডিপার্টমেন্টের দুই পরিচালক ছাড়াও একজন নারী ব্যবসায়ীকে আদালত ডেকেছেন।
তাদের বিষয়ে বিস্তৃত তদন্ত চলমান রয়েছে জানিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, পাপুল ইস্যুতে দেশি বিদেশি নতুন নতুন নামযুক্ত হচ্ছে এবং তা চাঞ্চল্য তৈরি করছে। বিশেষতঃ ‘বাঙালি এমপি’র কেসটি কুয়েতের রাজনীতি ও প্রশাসনে বাড়তি উত্তাপ তৈরি করেছে। দিনে দিনে এটি যেনো কেবলই বিস্তৃত হচ্ছে। পাপুলের স্বীকারোক্তি মতে শুক্রবার পর্যন্ত সন্দেহভাজন ৯ জন কুয়েতি হাই অফিসিয়্যালকে সিআইডি তাদের হেফাজতে নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সংবাদ সংস্থাগুলোর রিপোর্ট মতে, এক নারীসহ পাপুল কানেকশনে এ পর্যন্ত কুয়েতের সাবেক ও বর্তমান ৩ এমপি, স্বরাষ্ট্র ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের ৭ শীর্ষ কর্তাসহ মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করেছে কুয়েত-সিআইডি। তারা কড়া নজরদারিতে রয়েছেন। যে কোনো মুহুর্তে তাদের আদালতে উপস্থাপন করা হবে। পাপুলের কাছ থেকে মিলিয়ন দিনার ঘুষ বা উপহার পেয়েছেন তারা।
অবশ্য তাকে রিটার্ন বা বিনিময়ও দিয়েছেন। কুয়েতের স্বরাষ্ট্র ও জনশক্তি বিভাগের অসাধু, ঘুষগ্রহণকারী জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মোটা অংকের মাসোহারা-ঘুষ দেয়ার পরও জাল-জালিয়াতি আর ভিসা বাণিজ্যে বছরে পাপুলের নেট প্রফিট ছিল ২ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার। কুয়েতে মানবপাচারে হাজার কোটি টাকার কারবারে অভিযুক্ত হিসেবে সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলকে গত ৬ই জুনকে দেশটির ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট সিআইডি আটক করে। ৭ থেকে ১৪ ই জুন পর্যন্ত প্রাথমিক রিমান্ডে তিনি তার সিন্ডিকেট সদস্যদের বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করেন।
ইউরোপ-আমেরিকা ও মধ্যপাচ্যের অন্যত্র অর্থ সরিয়ে নেয়ার দায়ও কবুল করেন। মারাতিয়া কুয়েতি গ্রুপ অব কোম্পানীজ এর সত্বাধিকারী কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলকে ‘মাফিয়া বস’ কুখ্যাতি দিয়ে কুয়েতি সংবাদ মাধ্যম বলছে, বাংলাদেশি এমপি ব্যবসা পেতে কুয়েতি কর্মকর্তাদের বিশালবহুল ৫টি গাড়িসহ মিলিয়ন দিনার উপহার দিয়েছেন। আগে কুয়েতি পার্টনারের সঙ্গে ব্যবসা করলেও এ বছরে তিনি একজন মার্কিন ব্যবসায়ীর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলেন। কুয়েতে আয় করা বেশিরভাগ অর্থই তিনি আমেরিকা পাঠিয়ে দেন।
কুয়েতের একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করা পাপুল এ পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিককে কুয়েতে পাঠিয়ে ৫ কোটি কুয়েতি দিনার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকার বেশি) হাতিয়েছেন। যার বেশিরভাগই মিথ্যা আশ্বাস এবং তাদের ঠকিয়ে আদায় করা। আরব টাইমস অনলাইনের তথ্য মতে, সাধারণ শ্রমিক প্রতি ১৮০০- ২২০০ দিনার এবং ড্রাইভার ভিসায় জন প্রতি ২৫০০ থেকে ৩০০০ দিনার (যা বাংলাদেশি অর্থে সাড়ে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা) করে নিয়েছেন মাফিয়া পাপুল।
শুনানি আজ: এদিকে কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালামকে উদ্বৃত করে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানায়, ৩ দফা জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পর কারাঅন্তরীণ এমপি পাপুলের কেসের পরবর্তী শুনানি রোববার হতে পারে বলে আভাস মিলেছে। তবে এখনও এমপির মামলার বিষয়ে কুয়েতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে কিছু জানায়নি বলে শনিবারও দাবি করেন রাষ্ট্রদূত।
উৎসঃ মানবজমিন