আবদুল্লাহ আল মামুন, সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধিঃ সাতক্ষীরার শ্যামনগর মুকুন্দপুর গ্রামের ২৭ বছরের মনোয়ারা খাতুন ১৬ তারিখ রাতে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৭ ও ১৮ তারিখ শ্যামনগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই ঘটনায় নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালে মামলা দায়েরের পর আদালত হাসপাতাল হতে বাদির চিকিৎসা সনদ তলব করেন। এসময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী আসামী পক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঘটনা ১৫ তারিখের উল্লেখ করে ঐ নারী ১৬ তারিখে ভর্তি হয়- মর্মে আদালতে মিথ্যা ‘ইনজুরি রিপোর্ট’ প্রেরণ করেন।
ঘটনা ও ভর্তি তারিখের গরমিলের সুযোগে আসামীকে জামিন দেয়ার পাশাপাশি আদালত মামলা খারিজ করার ঘোষনা দেয়। একপর্যায়ে ভুক্তোভোগী মনোয়ারা নির্ভুল চিকিৎসা সনদ উপস্থাপনের জন্য আরও একবার আদালতের নিকট সময় প্রার্থনা করে। এসময় ভর্তির দিন-ক্ষণসহ শাররীক নির্যাতন সংক্রান্ত প্রকৃত প্রতিবেদন প্রদানের বিনিময়ে অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলম ভুক্তোভোগী নারীর নিকট হতে ২০ হাজার টাকা আদায় করেন।
একইভাবে প্রতিবেশীর হামলায় আহত পাইকামারী গ্রামের আক্তার হোসেনের স্ত্রী ফরিদা খাতুন(৩৫) গত ২৯ জানুয়ারী শ্যামনগর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে একদিন পর ছাড়পত্র নিয়ে বাড়িতে ফেরে। পরবর্তীতে মামলা হলে আদালত চিকিৎসা সনদ তলব করায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী ‘ভালো মানের’ চিকিৎসা সনদ দেয়ার শর্তে ১৮ হাজার টাকা দাবি করে। তবে দরিদ্র ভুক্তোভোগীর পরিবার ১২ হাজার টাকার বেশি দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করায় তার চিকিৎসা সনদে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয়।
এছাড়া গত ২২ জানুয়ারি পীরগাজন আশিকুড়া গ্রামের ডিএম মনিরুজ্জামানের হাতে নির্যাতিত হয়ে তার স্ত্রী শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয় ও নারী শিশু আদালতে মামলা করে। পরবর্তীতে জামিন গ্রহনের পুর্ব প্রস্তুতি হিসেবে বিভিন্ন মহলে তদবীরের পাশাপাশি স্ত্রী’র চিকিৎসা সনদের বিষয়ে ধারনা নিতে তিনি শ্যামনগর হাসপাতালে যান। একপর্যায়ে জাহাঙ্গীর আলম এক হাজার টাকা নিয়ে তাকে নির্যাতিতার ‘কেস সামারি’ লেখা রেজিষ্ট্রার খাতার ছবি মোবাইলে ধারনের সুযোগ দেয়।
পরবর্তীতে মোবাইলে ধারনকৃত ‘কেস সামারি’ পর্যবেক্ষন করে আইনজীবিরা জামিন সহজ করার জন্য বিবাদীকে যোগাযোগের মাধ্যমে মেডিকেল সনদ ‘নরমাল’ করার পরামর্শ দিলে মনিরুজ্জামান দ্বিতীয়বার জাহাঙ্গীরের দারস্থ হয়। আসামী সরকারি চাকরীজীবি নিশ্চিত হয়ে শুরুতে নরমাল চিকিৎসা সনদ প্রদানের বিনিময়ে জাহাঙ্গীর ৫০ হাজার টাকা দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকায় দফারফা হয়।
তবে শুধুমাত্র উল্লেখিত তিনটি ঘটনা নয়। বরং শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে এ ধরণের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। টাকার বিনিময়ে তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হওয়া রোগী ও তার প্রতিপক্ষের চাহিদামত চিকিৎসা সনদ সরবরাহ করেন বলে অভিযোগ। রেজিষ্ট্রার খাতা রক্ষণাবেক্ষণসহ দাপ্তরিক বিষয়াদী দেখভালের পাশাপাশি মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকের ব্যস্ততার সুযোগে অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলম এমন অপকর্ম করেন।
অভিযোগ রয়েছে অফিস সহকারী হিসেবে দীর্ঘদিন একই স্টেশনে চাকরির সুযোগে জাহাঙ্গীর আলম তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হওয়া রোগীদের অবস্থা বিবেচেনার পরিবর্তে টাকার অংকের উপর নির্ভর করে মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে চিকিৎসা সনদ পাইয়ে দিতে মুখ্য ভুমিকা পালন করেন তিনি। তার এমন অপকর্মের কারনে অসংখ্য দরিদ্র অসহায় ভুক্তোভোগী আদালতে যেয়ে ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
ওসমান আলী নামের কৈখালী গ্রামের এক বৃদ্ধ জানান গত ১৯ এপ্রিল প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক আহত হয়ে তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় শ্যামনগর হাসপাতালে ভর্তি হলেও জাহাঙ্গীরের কারসাজিতে অপরাধীরা স্বল্প সময়ের মধ্যে জামিন নিয়ে এলাকায় ফিরে তাকে হুমকি দিচ্ছে। তার মত আরও অনেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলমের টাকার যোগান দিতে ব্যর্থ হয়ে ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছে বলেও তার দাবি।
অভিযোগের বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম জানান, থানা থেকে কোন প্রতিবেদন চাইলে আমি কাগজপত্র প্রস্তুত করে মেডিকেল বোর্ডের সামনে উপস্থাপনের পর তারা চিকিৎসা সনদ দেন। এখানে বোর্ডকে প্রভাবিত করার তিনি কোন সুযোগ রাখেন না দাবি করে তিনি আরও বলেন মনোয়ারা খাতুনকে নিয়ে একটি অভিযোগ হওয়ায় বিষয়টি উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ তদন্ত করছেন। মানসিক অবস্থা ভাল না-দাবি করে পরক্ষনে তিনি ব্যস্ত থাকার কথা জানিয়ে তার মুটোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও প: প: কর্মকর্তা ডা: জিয়াউর রহমান জানান, ইতোমধ্যে একটি অভিযোগ আমার হাতে এসেছে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে বিষয়টি নিয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া যায়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে সত্যিকারের সেবাদান প্রতিষ্ঠানে পরিনত করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অভিযোগের সত্যতা মিললে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।