বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে ফিরে হোটেল কোয়ারেন্টিনে অমানবিক আচরণের শিকার হওয়া একটি বাংলাদেশি পরিবার আদালতের দ্বারস্ত হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটির আইনজীবী তাহমিনা কবীর রবিবার বিকেলে জানান,ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে বাংলাদেশকে করোনার রেড জোন লিস্ট থেকে বাদ দিতে আইনি প্রক্রিয়ার দিকে এগুচ্ছেন তারা। কারণ এই বিশাল ব্যয় বহুল হোটেল কোয়ারেন্টিনে অনেককেই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ২ এপ্রিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে ভ্রমণের লাল তালিকাভুক্ত করে যুক্তরাজ্য। এসব দেশ থেকে যারা ব্রিটেনে আসবেন তাদেরকে বাধ্যতামূলক করোনা পরীক্ষাসহ হোটেল কোয়ারেন্টিনে থাকার নিয়ম চালু করা হয়েছে। গত সোমবার লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ভারতকে। ২৪ এপ্রিল থেকে ভারতীয় নাগরিকদেরও যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
ভুক্তভোগীরা জানান, বাংলাদেশ থেকে ফেরার পরে লন্ডনে হোটেল কোয়ারেন্টিনে অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে ফেরত আসা যাত্রীরা।
অস্বাস্থ্যকর ও বন্দির মতো পরিবেশে রাখার জন্য বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি দুটি পরিবার ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাদের আইনজীবীদের অভিযোগ, এই দুটি মুসলমান পরিবারকে ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী যথাযথ খাবার না দেওয়া, হোটেলে অপরিষ্কার বিছানায় ঘুমাতে বাধ্য করা এবং মুক্ত বাতাস থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। যা তাদের প্রতি সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল।
ব্রিটেনের কোয়ারেন্টিন নীতিমালায় যা আছে
সরকারের ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী ব্রিটিশ নাগরিক ও যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদেরকে এদেশের ঢোকার পর সরকার অনুমোদিত হোটেলে নিজ খরচে ১০ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত হোটেলগুলোতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ন্যুনতম এ দশ দিনের হোটেল কোয়ারেন্টিনের জন্য যাত্রী প্রতি ১ হাজার ৭৫০ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ তিন হাজার টাকার বেশি) দিতে হবে। দশ দিনের অতিরিক্ত প্রতি দিনের জন্য যাত্রীকে দিতে হবে ১৫২ পাউন্ড করে। পাঁচ থেকে ১২ বছরের শিশুদের জন্য এ খরচ যথাক্রমে ৩২৫ ও ১২ পাউন্ড এবং বারো বছরের বড় শিশুদের জন্য যথাক্রমে ৬৫০ ও ৪১ পাউন্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। কোয়ারেন্টিন সময়ে দ্বিতীয় এবং অষ্টম দিনে প্রত্যেক যাত্রীকে করোনা টেস্ট করাতে হবে। পজিটিভ হলে সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত রুমে থাকলে রাতপ্রতি অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
পাঁচ দিন সময়মতো সেহরির খাবার না পাওয়ার অভিযোগ শফিউলের
ভুক্তভোগী ব্রিটিশ-বাংলাদেশি শফিউল আজম (৩৯) হিথরোর ক্রাউন প্লাজা হোটেলে ১৪ এপ্রিল থেকে তার ৯ বছর ও ৭ বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে কোয়ারেন্টিনে আছেন। তিনি তার স্ত্রী ও আরও দুই সন্তানকে বাংলাদেশে রেখে এসেছেন। একসঙ্গে ছয়জনের কোয়ারেন্টিন হোটেল ব্যয় তার পক্ষে বহন করা কঠিন বলে তিনি দুই ছেলেকে নিয়েই ফিরে আসেন।
রবিবার তিনি তার আইনজীবী তাহমিনা কবীরের মাধ্যমে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তাকে যে খেজুর খেতে দেওয়া হয়েছে এতে পোকা ছিল। তিনি আরও জানান, তার ছেলেরা পৌঁছার পরে ক্ষুধার্ত ছিল এবং বলার পরেও প্রায় তিন ঘণ্টা পরে তাদের রাত সাড়ে ৯টায় খাবার দেওয়া হয়। যা ছিল একেবারে খাবার অযোগ্য। পরের দিন তার ছেলের ডায়রিয়া হয় ও বমি করতে থাকে, যা কয়েকদিন স্থায়ী হয়। কিন্তু তাদের কোনও মুক্ত বাতাস গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি।
শফিউল আজম অভিযোগ করেন, পাঁচ দিন সময়মতো তার পরিবার সেহরির সময় কোনও খাবার পাননি। খাবার পানি পেতেও তাদের দেরি হয়। রাতের বেলা খুব ঠান্ডা থাকলেও তাদের হিটার কাজ করছিল না।
কোয়ারেন্টিনে থাকা বাংলাদেশি জানান, বিকাল ৫টায় তিন বোতল পানি চেয়েছিলেন ওই দিন রাত দশটার দিকে দেওয়া হয়। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাধ্য হয়েই তিনি আইনের আশ্রয় নিয়েছেন।
তিনি বলেন, তারা প্রত্যেকবারই বলে তাদের ১৫০০ রুম রয়েছে এবং তারা খুব ব্যস্ত, কিন্তু পানির জন্য এত সময় লাগার কথা নয়। পানি একটি সাধারণ চাহিদার ব্যাপার। এই কাজটুকু করতে না পারলে এসব হাতে নেওয়ার কোনও মানে নেই। তিনি আরও বলেন, আমি জানি এটি জনস্বাস্থ্যের বিষয়। কিন্তু এই হোটেলের ব্যবস্থাপনা একেবারে ভয়াবহ খারাপ।
শফিউলের গ্রামের বাড়ী চট্রগ্রামে। তার আইনজীবী পুর্ব লন্ডনের তাহমিনা সলিসিটার্সের তাহমিনা কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তারা অসংখ্য অভিযোগ পাচ্ছেন কোয়ারেন্টিন হোটেলগুলোর বিরুদ্ধে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ঠান্ডা এবং অনুপযুক্ত খাবার, হিটিং না থাকা এবং পরিষ্কার বেডশিট ও টাওয়াল না দেওয়া। তিনি বলেন, ব্রিটিশ ছেলে মেয়েদের জন্য যথাযথ খাবার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশের ব্যবস্থা করতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাইকোর্টের আদেশ অবজ্ঞা করছেন, যার কারণে কোর্ট আবারও সরকারকে সুষ্টু পরিবেশ ও খাবার দেওয়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে। ইফতারে দেওয়া পোকাযুক্ত খেজুর শুধু অনৈতিকই নয়, বৈষম্যমুলকও।মক্কেলের পক্ষে অন্তত চারবার হোটেল কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমেও কোয়ারেন্টিনে অমানবিক আচরণের কথা
ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও এশিয়ান ইমেজসহ স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, কোয়ারেন্টিনের জন্য নির্ধারিত একটি হোটেলে নিম্নমানের সেবা এবং খাবারের পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, অনুপযুক্ত খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। একটি পরিবার চারদিনের মধ্যে দুই বার হাইকোর্টে গেলে হিথরো এয়ারপোর্টের নিকটবর্তী হলিডে ইন হোটেলকে পরিস্থিতির উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হলেও আদতে তা অবজ্ঞা করা হয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এরমধ্যে কিছু হোটেল বাসিন্দা তাদের সঙ্গে ‘মানুষের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে না’ বলে অভিযোগ করেছেন। তাদের আইনজীবীরা বলছেন, এমন আচরণ অনেতিক ও নিন্দনীয় এবং অবশ্যই বেআইনি। বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে তাদের রাখার পর কোয়ারেন্টিন হোটেলের জন্য যে ভাড়া পরিশোধ করছেন সেটিকে তারা চাঁদাবাজির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, হলিডে ইন এক্সপ্রেসে পাঁচ জনের একটি পরিবার ১০দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য উঠেন। তাদেরকে পাশাপাশি সংযুক্ত দুটি রুম দেওয়া হয় যা একদম আবদ্ধ। রুমে একটি চেয়ার ও একটি টেবিল রয়েছে।
আদালতে তাদের অভিযোগে জানা গেছে, সেখানে রুমের জানালা খোলার কোনও ব্যবস্থা নেই, বাইরে ময়লা নেওয়ারও কোনও ব্যবস্থা নেই। যা একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশ পাকিস্তানি এই পরিবার হোটেলের জন্য ৪ হাজার ২৫ পাউন্ড পরিশোধ করেছে। তারা অভিযোগ করেছে, তাদেরকে বেকন এবং পর্ক এর বার্গার খেতে দেওয়া হয়েছে।
কোয়ারেন্টিন থেকে বের হওয়ার আগের দিন নাহিদা খান (৪৭) নামের ওই নারী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এটি ছিল একটি দুঃস্বপ্নের মতো। খাবার ছিল খুবই খারাপ, অরুচিকর, যা সম্পুর্ণ খাবারের অযোগ্য। পর্ক বাগার্র এবং পানিনি দেওয়া হয় যা মুসলমান হিসেবে তারা খেতে পারেন না। তাদের সন্তানেরা শুধু সেরিয়েল ও ক্রিস্প খেয়েছে।
নাহিদা খান বলেন, যেহেতু আমাদের একটি চেয়ার ছিল তাই বিছানায় বসে খাবার খেতে হয়েছে এবং তা নোংরা হয়ে যায়। তিন চার দিন পর তাদের পরিষ্কার বেডশিট নিয়ে আসার জন্য বলা হয়েছে। বাধ্য হয়েই আমাদের নোংরা বিছানার চাদরে ঘুমাতে হয়েছে। আমার কিছু করার ছিল না।
এই পরিবারের আইনজীবী হাই কোর্টে মামলা করলে শুক্রবার আদালত সরকারকে নির্দেশ দেয়, সোমবারের ভেতরে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়ার। বিচারক লেইং নির্দেশ দেন, তারা সত্যিকারভাবে কোয়ারেন্টিনে অসুবিধা ভোগ করছেন, বিশেষ করে তাদের শিশুদের স্বাস্থ্য ও ভালো থাকার বিষয় নিয়ে। মুসলমান হিসেবে তাদের খাবারের ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
উৎসঃ বাংলা ট্রিবিউন