তোফাজ্জল হোসেন রুবেল: একজন শ্রমিক বিদেশ যেতে হলে তাকে ৩০০ টাকা দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। ‘আমি প্রবাসী’ নামের একটি অ্যাপসের মাধ্যমে নিবন্ধনের টাকা নেয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। অ্যাপসটি তৈরি করার পর গত চার মাসে প্রায় আড়াই লাখ বিদেশগামী শ্রমিকের কাছ থেকে সাড়ে ৭ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এ অর্থ সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার কথা থাকলেও আড়াই কোটি টাকা জমা হয়েছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে। অ্যাপস তৈরির নামে একটি চুক্তির মাধ্যমে এ অর্থ নিয়েছে থ্যান সিস্টেম নামের একটি প্রতিষ্ঠান। চুক্তি অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটির পকেটে যাবে সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা। বেসরকারি এ প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদের ভাগ্নে নামির আহমেদ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের রাজস্ব ভাগাভাগির আইনগত কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংযুক্ত তহবিলের পরিবর্তে রাজস্বের এ অর্থ জমা হচ্ছে একটি বেসরকারি ব্যাংকে। এটি পিপিআর ২০০৮, সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯-এর ধারা ৭ এবং ট্রেজারি রুলসের রুল-৩ ও ৭ (১)-এর সুস্পষ্ট লংঘন বলে কর্মকর্তারা বলছেন। এভাবে চলতে থাকলে এতে একদিকে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হবে, অন্যদিকে বিএমইটি কার্যত অচল হয়ে যাবে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সরকারের রাজস্ব বা সেবা থেকে যে অর্থ আসে তা এভাবে ভাগাভাগি করার সুযোগ নেই। বিএমইটি যদি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে করত; তাহলে হয়তো এমনটি হতো না। সরকার যদি মনে করে রাজস্ব বা সেবার অর্থ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভাগাভাগি করবে; তাহলে অবশ্যই বিধি পরিবর্তন করতে হবে।’
মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি সূত্র জানায়, থ্যান সিস্টেম নামের প্রতিষ্ঠানটির মালিক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর ভাগ্নে নামির আহমেদ। চলতি বছরের ৮ মে থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ লোক এ অ্যাপসের মাধ্যমে নিবন্ধন করেছে। সেখানে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে মোট ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা নিবন্ধন ফি হিসেবে পেলেও সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে ৫ কোটি টাকা। বাকি ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা নিয়েছে নামিরের প্রতিষ্ঠান। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ বছর এ প্রতিষ্ঠানটি মোট সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা নেবে। যদিও জেলা পর্যায়ে বিএমইটির ৪২টি ডেমো অফিস রয়েছে। সেখানেও নিবন্ধন চলছে। তবে সেখানে এখন আর খুব একটা লোকজন যাচ্ছে না।
থ্যান সিস্টেমের হেড অব অপারেশনস তানভির সিদ্দীকী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএমইটির নির্ধারিত ফি তাদের কোষাগারে জমা হচ্ছে। আমরা চুক্তি অনুযায়ী ২০০ টাকার স্থলে ৩০০ টাকা নিচ্ছি। এখানে ১০০ টাকা আমরা পাচ্ছি। সেই টাকা থেকে অ্যাপসের সব খরচ বহন করি।’ এ প্রতিষ্ঠানের মালিক মন্ত্রীর আপন ভাগ্নে নামির জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে নামির সাহেব দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। উনাকে পাওয়া সম্ভব হবে না।’
নথিপত্র পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্টরে সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপসের মাধ্যমে বিদেশগামীদের জন্য নিবন্ধন ফি ৪০০ টাকা করা হয়। সেই অনুযায়ী চুক্তিও হয়েছে। যদিও বর্তমানে সমালোচনা এড়াতে ৩০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। পরে তা যেকোনো সময়ে বাড়ানো হতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। অথচ সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একজন বিদেশগামী কর্মীর কাছ থেকে নিবন্ধন ফি ২০০ টাকা নেওয়ার কথা।
বিএমইটির এক কর্মকর্তা বলেন, এ অ্যাপসের সঙ্গে চুক্তির আগে এ বিষয়ে দায়িত্ব দিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালকে (বুয়েট) অনুরোধ করে একটি চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠির পর বুয়েটের আইসিটি বিভাগ ভবিষ্যতে কারিগরি সমস্যা হবে উল্লেখ করে পাল্টা চিঠি দিয়ে দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। বুয়েট যেখানে দায়িত্ব নিতে চাইছে না সেখানে একটি অখ্যাত আইটি প্রতিষ্ঠানকে এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কীভাবে দেওয়া হলো। এছাড়া এ অ্যাপসের ফলে নানা জটিলতাও তৈরি হচ্ছে। এ কর্মকর্তা আরও বলেন, এই অ্যাপসে অনেক ত্রুটির কথা উল্লেখ করে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে সিনিয়র সহকারী সচিব মো. সরোয়ার আলম গত ২৩ মে বিএমইটিতে একটি চিঠি দেন। সেখানে বলা হয়, ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপসে কারিগরি ত্রুটির জন্য পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন প্রায় ৫০ ভাগ করা যাচ্ছে না। এরপরও অ্যাপসের মাধ্যমে ই-বহির্গমন ছাড়পত্র, ই-নিয়োগ অনুমতি, ই-কালো তালিকাভুক্তি, ই-ওয়ার্ক ভিসা, ই-মেডিকেল, ই-কারিগরি ট্রেনিং সেন্টার, ই-পদ্ধতিতে রাজস্বের টাকা আদায়ের জন্যও একটি প্রস্তাব দিয়েছে নামিরের মালিকানাধীন থ্যান সিস্টেম। এসব বাস্তবায়ন হলে জেলা পর্যায়ে থাকা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস কার্যত অচল হয়ে যাবে। শ্রমিকদের নিবন্ধন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে যাওয়ার পর জেলা পর্যায়ের অফিসগুলো এখনই স্থবির হয়ে পড়েছে। আর বাকিগুলো চুক্তির মাধ্যমে তাদের কব্জায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।
আইন ভঙ্গ করে ব্যাংক লেনদেন : চলতি বছরের ২৯ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট অনুবিভাগ থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়, সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯-এর ধারা ৭ এবং ট্রেজারি রুলসের রুল-৩ ও ৭ (১) অনুযায়ী সরকারের সব ধরনের রাজস্ব ও বিভিন্ন সেবা ফি সরাসরি সরকারের সংযুক্ত তহবিলে জমা করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে (টিএসএ) জমার বিধান রয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন বিভাগ মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তর ও পরিদপ্তর অর্থ বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ ব্যতিরেকে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে রাজস্ব সেবা ফি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক বা এর এজেন্ট সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ব্যতীত অন্য কোনো ব্যাংকে জমা রাখছে; যা সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি পরিপন্থী।’
পরিপত্রে আরও বলা হয়, আইন ও বিধির সঙ্গে মিল রেখে সরকারের রাজস্ব ও ফি জমা দেওয়ার বিদ্যমান পদ্ধতি সহজীকরণের লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ১৮ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ‘এ চালান’ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। যেসব মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থা সরকারি রাজস্ব বা অর্থ বেসরকারি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ জমার চুক্তি করেছে তা তাদেরকে অনতিবিলম্বে চুক্তি বাতিল করে ‘এ চালান’ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকে টিএসএ’র মাধ্যমে জমা দেওয়ার নিশ্চিত করতে হবে।’
‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপসের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিএমইটি পাচ্ছে তা রাজধানীর মগবাজার এলাকায় থাকা বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকে জামা হচ্ছে। এ টাকা একটি মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির মাধ্যমে নিয়ে থ্যান সিস্টেমের পক্ষ থেকে ব্যাংকে জমা করা হয়। চুক্তিতে যদিও বলা আছে প্রতি সাত দিন পরপর নিবন্ধনের অর্থ ব্যাংকে জমা দেবে থ্যান সিস্টেম। কিন্তু তারা (থ্যান সিস্টেম) কখনো কখনো তা মাসে একবার জমা করে। সরকারি অর্থ নিয়ে এমন নৈরাজ্য আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না বলেও জানান বিএমইটির একাধিক কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের (বাজেট অনুবিভাগ) উপসচিব মো. তৌহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন ও ট্রেজারি রুলস অনুযায়ী রাজস্ব ও বিভিন্ন সেবা ফি সরাসরি সরকারের সংযুক্ত তহবিলে জমা হবে। এখানে সোনালী ব্যাংক ব্যতীত অন্য কোনো ব্যাংকে এ ধরনের লেনদেনের আইনগত বৈধতা নেই। এ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান যদি অ্যাপস তৈরি করে রাজস্ব বা সেবা ফি সংগ্রহ করে তাহলে সেই অ্যাপস তৈরির জন্য সরকারের ব্যয় খাত থেকে টাকা খরচ করতে পারে। কোনোভাবেই রাজস্ব বা সেবা ফি আদায়ের আয় করা খাত থেকে টাকা খরচ করার সুযোগ নেই।’
চুক্তির আইনগত ভিত্তি নিয়ে বিএমইটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, পাবলিক প্রকিউমেন্ট রুলস (পিপিআর), ২০০৮-এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী কিউসিবিএস পদ্ধতিতে ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপস তৈরির জন্য থ্যান সিস্টেমকে কাজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিধান অনুযায়ী এ কাজের অনুমোদন দিতে হলে তা সরকারপ্রধান পর্যন্ত ফাইল যাওয়ার কথা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের ডিজি শামসুল আলমের সময়ে চুক্তি হলেও তা তড়িঘড়ি করে বাস্তবায়ন করেছেন বর্তমান মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম। তিনি আরও কয়েকটি অ্যাপসের মাধ্যমে বাকি কাজগুলোও মন্ত্রীর ভাগ্নের প্রতিষ্ঠানকে দিতে মরিয়া। অথচ বিএমইটি মূলত এ কাজগুলোই করে থাকে। এসব কাজ বেসরকারি খাতে দিয়ে দিলে কার্যত বিএমইটির হাতে খুব একটা কাজ থাকবে না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কাজের সুবিধার্থে আমরা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এটি শেয়ার করেছি। সরকার যদি এমন একটি অ্যাপস তৈরি করে তা রক্ষণাবেক্ষণ করতে চায় তাহলে অনেক টাকা খরচ হবে। তাই আমাদের নির্ধারিত টাকা ঠিক রেখে ১০০ টাকা বাড়িয়ে তা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। চুক্তিটি মূলত মন্ত্রণালয় থেকে করেছে। এ বিষয়ে আইন-কানুন ও অন্যসব বিষয়ে বিস্তারিত মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।’
সাবেক ডিজি শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের জেলা পর্যায়ের অফিসগুলো চালু আছে। সেখানে অনেকেই নিবন্ধন করছে। কাউকে অ্যাপসের মাধ্যমে জোর করে নিবন্ধন করানো হচ্ছে না। যার ইচ্ছে হয় সে করবে।’
সরকারের রাজস্বের অর্থ কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভাগাভাগি করার আইন অনুযায়ী সুযোগ আছে কিনা এমন এক প্রশ্নের উত্তরে সাবেক ডিজি বলেন, ‘এ চুক্তিটি পুরোপুরি আমার দায়িত্ব পালনকালে হয়নি। এরপরও আমি যতটুকু করেছি সবই করেছি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। তারা নির্দেশ দিয়েছে আমরা তা পালন করেছি। বিস্তারিত এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।’
এ বিষয়ে কথা বলতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
উৎসঃ দৈনিক রূপান্তর