তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলায় সময়ের ব্যবধানে বেড়েছে মাল্টা চাষ। ফলন ভালো হওয়ায় চাষিরা ঝুঁকছেন এই ফল চাষে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগে চাষ করছেন মাল্টা। আগে সাধারণত কমলার দিকেই ঝোঁক বেশি ছিল চাষিদের, তবে এখন অনেকেই মাল্টার বাগান গড়ে তুলছেন। প্রতিবছর বাড়ছে এই বাগানের সংখ্যা। তেমনি একটি বাগান গড়ে তুলেছেন জাবের আহমদ। তার বাগানে ১২ শতাধিক মাল্টা গাছ রয়েছে। মাল্টার পাশাপাশি কিছু অংশে গড়ে তুলেছেন কমলার বাগান। তিন বছর আগে কৃষি বিভাগের পরামর্শে সাড়ে তিন একর জায়গার ওপর এই বাগান গড়ে তুলেছেন তিনি।
কৃষি বিভাগ জানায়, মাল্টা দেখতে সবুজ হলেও খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু ও মিষ্টি। বারি-১ জাতের এই মাল্টার উৎপাদন বাড়ছে জুড়ীতে। সম্ভাবনাময় এই ফসল চাষাবাদে তুলনামূলক খরচ কম থাকায় সহজে ফলন হয়। সে জন্য কৃষকরা ঝুঁকছেন এখন মাল্টা চাষের দিকে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, জুড়ী উপজেলায় ২৪ হেক্টর জমিতে মাল্টা বাগান গড়ে উঠেছে। গত বছর যা ছিল ২১ হেক্টর। উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে কমবেশি মাল্টার আবাদ হচ্ছে। রয়েছে ছোট-বড় শতাধিক বাগান। জুড়ী উপজেলার পূর্বজুড়ী, ফুলতলা, সাগরনাল ও গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নে এর ফলন হচ্ছে বেশি। কেউ করেছেন সখের বসে চাষাবাদ আবার কেউ কেউ বাণিজ্যিক চিন্তাধারা নিয়ে। এ বছর জুড়ীতে মাল্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৭ টন।
সরজমিনে পূর্ব জুড়ী ইউনিয়নের বিনোদপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে বড় বড় দুটি পাহাড়ে প্রায় ১২ শতাধিক মাল্টার গাছ দিয়ে তৈরি করেছেন বিশাল বাগান। মাত্র তিন বছর পূর্বে প্রায় সাড়ে তিন একর জমিতে মাল্টা চাষ শুরু করেন জাবের আহমদ। গাছ রোপণের পরের বছর থেকে ফল পাওয়া শুরু হয়। গতবছর থেকে তিনি এই বাগান থেকে মাল্টা পাচ্ছেন। মাল্টার পাশাপাশি তার একই টিলাভূমিতে রয়েছে কমলা ও জারালেবু। এ ছাড়াও এর পাশের জমিতে রয়েছে মাছের ঘের, হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগলের খামার। কিছুটা সরকারি হলেও বাকিটা সম্পূর্ণ করেছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
বাগানের নিয়মিত পরিচর্যা করা রমজান আলী বলেন, এ বছর ফলন অনেক ভালো হয়েছে। গাছের চেয়ে ফল বেশি হওয়ায় ফুল থাকতেই মেডিসিন দিয়ে ঝরানো হয়েছে। অতিরিক্ত ফল হলে গাছ দুর্বল হয়ে যায়। তাই কৃষি অফিসারের পরামর্শে এই কাজ করা হয়। আগামী বছর থেকে গাছে যে ফল আসবে সবগুলো রাখা যাবে।
তিনি বলেন, বাজারে যে মাল্টা পাওয়া যায় তার চেয়ে এই ফলগুলো বেশি মিষ্টি। সাইজেও এই মাল্টাগুলো বড় হয়। ছয় থেকে সাতটি মাল্টায় কেজি হয়। বাজারে মাল্টা কেজি বিক্রি হয় সাড়ে তিনশ টাকা করে। আর আমরা বিক্রি করি দুইশ টাকা করে।
জুড়ীর বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় মাল্টা বাগানের মালিক জাবের আহমদ বলেন, পূর্বজুড়ী ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুরঞ্জিত ধর রনির পরামর্শে আমি মাল্টা বাগান শুরু করি। সরকার থেকে সারসহ সকল ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি। কৃষি অফিসের কর্মকর্তাগণ নিয়মিত বাগান দেখছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন। এ বছর মাল্টার ফলন ভালো হয়েছে। গাছ ছোট থাকায় ভারসাম্য রক্ষার জন্য কিছু গাছের মাল্টা আমরা গাছ থেকে ছাঁটাই করেছি কৃষি অফিসারের পরামর্শে। আশাকরি আগামী বছর আমাদের মাল্টার বাম্পার ফলন হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বাগানে সরকার থেকে প্রদর্শনীসহ নিজ খরচে ১২শ মাল্টা গাছ, চারশ কমলা গাছসহ লেবু জাতীয় বিভিন্ন প্রজাতির ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন একর জায়গার ওপর আমাদের মাল্টা বাগান। প্রতিনিয়ত দুইজন লোক আমাদের বাগানে কাজ করে।
উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের লাঠিটিলার ডোমাবাড়ি গ্রামের খোর্শেদ আলম তিন বছর আগে ১০ শতক জায়গার ওপর গড়ে তোলেন মাল্টা বাগান। গত বছর ফল আসলেও তেমন ভালো হয়নি। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর প্রত্যেক গাছে বারি-১ জাতের মাল্টায় স্বপ্ন দেখছেন তিনি। ফলন ভালো হওয়ায় নিজের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন এসব মাল্টা। সুস্বাদু এই মাল্টার প্রতি আগ্রহ মানুষের। যার জন্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে খুব সহজেই। এবং সহজেই সানন্দে হাতিয়ে নিচ্ছেন।
খোর্শেদ আলম বলেন, সরকারিভাবে জুড়ী উপজেলা থেকে ১০ শতাংশ জায়গায় ৩০টি গাছের একটি প্রদর্শনী পান তিনি। গাছের বয়স এখন চার বছর হয়েছে। এ বছর প্রতিটি গাছে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০টি করে ফল এসেছে। ছোট ছোট গাছের ফল দেখে অনেকের উৎসাহ বেড়েছে মাল্টা চাষের প্রতি। কেউ কেউ উদ্যোগ নিয়েছেন আগামীতে মাল্টা চাষে মনোযোগ দেবেন।
জুড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকতা মো. মাহমুদুল আলম খাঁন বলেন, লেবু জাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। কৃষি অফিসের পরামর্শে মাল্টা চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। শুকনো মৌসুমে মাল্টার উৎপাদন বাড়াতে গাছের পরিচর্যায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে। এই প্রযুক্তিতে পানি ও সার একসঙ্গে দেওয়া যাবে ড্রিপ ইরিগেশনের মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন, যারা মাল্টা চাষ করেছে তাদের ফলন ভালো হয়েছে। এ বছর নতুন মাল্টা চাষি ৪৫ জন বেড়েছেন। অফিস থেকে প্রদর্শনী প্রাপ্ত কৃষকদের ছয় রকমের সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, সিকেচার, স্প্রে মেশিন এবং মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়াও শুকনো মৌসুমের জন্য মালচিং পিপার বিতরণ করা হয়েছে।