করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে এসে আটকে পড়েছেন অনেক প্রবাসী। আটকেপড়া এসব প্রবাসীদের কর্মস্থলে ফেরাতে সাত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিমানবন্দরে করোনা টেস্ট (আরটি-পিসিআর) ল্যাব স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে সরকার। অনুমতির পর সংশ্লিষ্ট সাত প্রতিষ্ঠান থেকে ল্যাব স্থাপনের জন্য বিমানবন্দরে তাদের কার্যক্রম শুরু করার কথা। কিন্তু সিভিল অ্যাভিয়েশন থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিমানবন্দরের গাড়ি পার্কিংয়ের ছাদের ওপরে ল্যাব স্থাপনের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর এতেই বেঁধেছে বিপত্তি।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বলা হচ্ছে, সরকারের বেঁধে দেওয়া তিন থেকে ছয় দিনের মধ্যে ছাদের ফাঁকা জায়গায় আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপন সম্ভব নয়। কারণ ছাদের ওপরে ল্যাব স্থাপন করতে গেলে সেখানে রুম তৈরি করা, এসি লাগানো, ল্যাবের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য ন্যূনতম বায়োসেফটি লেভেল ঠিক করা, কুল বক্স প্রতি বুথের জন্য, বায়োসেফটি কেবিনেট, পিসিআর কেবিনেট, চেঞ্জিং রুম, ওয়াশিং এবং হ্যান্ড ওয়াশিং সুবিধাসহ অনান্য কাজগুলো সম্পন্ন করতে কমপক্ষে মাস খানেকের বেশি সময় প্রয়োজন হবে।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, বিমানবন্দরে সুনির্দিষ্ট কোনো কক্ষ যদি তাদের ল্যাবের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাহলে কম সময়ের মধ্যেই সবগুলো কাজ শেষ করে তাদের ল্যাব স্থাপন করা সহজ হতো। এ কারণে সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন না বলে তারা জানিয়েছেন।
অপরদিকে সিভিল অ্যাভিয়েশন বলছে, তারা অফিসিয়ালি সিদ্ধান্ত নিয়েই পার্কিংয়ের ছাদের ল্যাবের জন্য জায়গা বরাদ্দ করেছেন। এখন কত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তা করতে পারবে সেটা তাদের বিষয়। ল্যাব স্থাপনের জন্য চাহিদামতো রুম তাদের কাছে নেই।
বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের দেওয়া সব শর্ত মেনে ৩-৬ দিনের মধ্যে খোলা ছাদের ওপরে ল্যাব স্থাপন করা সম্ভব নয়। আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি।”
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল অ্যাভিয়েশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা অফিসিয়ালি সিদ্ধান্ত নিয়েই পার্কিংয়ের ছাদের ল্যাবের জন্য জায়গা দিয়েছি। এখন তারা কতদিনে করতে পারবেন সেটা তো আমাদের বিষয় না।’
জানা গেছে, আরব আমিরাত সরকারের শর্ত অনুযায়ী, দেশটিতে প্রবেশ করতে হলে সঙ্গে থাকতে হবে বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট। তাই ল্যাব স্থাপনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন আটকে পড়া প্রবাসীরা। করোনা ভাইরাস শনাক্তে এখন পর্যন্ত বিশ্বে যে কটি নমুনা পরীক্ষা পদ্ধতি আছে, তার মধ্যে আরটি-পিসিআরই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। এ পদ্ধতিতে রোগীর নাসারন্ধ্র বা মুখের ভেতর থেকে মিউকাস বা লালা সংগ্রহ করা হয়। এতে প্রায় ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগে।
ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টেকনিক্যাল কমিটি এসব ল্যাব পরিচালনার জন্য প্রায় ২৫টি শর্ত জুড়ে দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সুত্র জানায়, দেশের বিমানবন্দরে আরটি পিসিআর টেস্ট করানোর ব্যবস্থা না থাকায় আরব আমিরাতগামী প্রায় ৫০-৬০ হাজার প্রবাসী আটকে পড়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে আরটি পিসিআর ল্যাব স্থাপনের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সপ্তাহান্তেও কোনো সুরাহা না হওয়ায় ফের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাগিদ দেওয়া হয়। এর পরই নড়েচড়ে বসেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল বুধবার সাত প্রতিষ্ঠানকে বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের অনুমোতি দেয় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
এদিকে পিসিআর টেস্টের দাবিতে মঙ্গলবার প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সামনে আমরণ অনশনে যান প্রবাসীরা। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রণালয় না ছাড়ার ঘোষণা দেন। দাবি পূরণে তাদের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মন্ত্রী ইমরান আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। পরে মন্ত্রীর আশ্বাসে তারা অনশন ভেঙে মন্ত্রণালয় ছাড়েন।
প্রবাসীদের সেই কঠোর কর্মসূচির একদিন পরই গতকাল সাত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিমানবন্দরে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার জন্য র্যাপিড পিসিআর টেস্ট মেশিন স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে গুলশান ক্লিনিক লিমিটেড, স্টেমজ হেলথ কেয়ার (বিডি) লিমিটেড, সিএসবিএফ হেলথ সেন্টার, এএমজেড হাসপাতাল লিমিটেড, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জয়নুল হক সিকদার ওমেন্স মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল প্রাইভেট লিমিটেড, ডিএমএফআর মলিকুলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক।
এসব ল্যাব স্থাপনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে তিন থেকে ছয় দিন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান ভেদে পরীক্ষা ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টেকনিক্যাল কমিটি এসব ল্যাব পরিচালনার জন্য প্রায় ২৫টি শর্ত জুড়ে দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
শর্তের মধ্যে রয়েছে সীমিত সময়ের মধ্যে অধিক সংখ্যক পরীক্ষ সম্পন্ন করতে হবে, নমুনা সংগ্রহের পর সঠিক সময়ে প্রতি আরটি পিসিআর মেশিনে আনুমানিক তিন ঘণ্টায় একসঙ্গে ৯৪টি পরীক্ষা করতে হবে। ল্যাবের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য ন্যূনতম বায়োসেফটি লেভেল-২ হতে হবে। গুণগত পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ কক্ষ, কুল বক্স প্রতি বুথের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বায়োসেফটি কেবিনেট, ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ডিপ ফ্রিজ, অটো এক্সট্রাকশন মেশিন, ভরটেক্স মেশিন, পিসিআর কেবিনেট, মিনি সেন্ট্রিফিউজ, ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ফ্রিজও থাকতে হবে। ল্যাবরেটরিতে চেঞ্জিং রুম, পর্যাপ্ত পরিমাণ পিপিই, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বায়ো হ্যাজার্ড ব্যাগ, অটোক্লেভ মেশিন, ওয়াশিং এবং হ্যান্ড ওয়াশিং সুবিধা থাকতে হবে। প্রিজম বা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে নির্ধারিত অনুরূপ কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করতে হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চুক্তি।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মো. খুরশীদ আলমের নেতৃত্বে কারিগরি কমিটির বৈঠক হয়। ল্যাব স্থাপনে আগ্রহী ২৩ প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব ওই বৈঠকে যাচাই-বাছাই শেষে মূল্যায়ন করা হয়।
উৎসঃ দৈনিক আমাদের সময়