দু’টি বন্ধু রাষ্ট্রের সহযোগিতায় পরিচালিত এক জরিপে বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে ১৭ থেকে সর্বোচ্চ ১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট (টিসিএফ) গ্যাস হাইড্রেট-এর সন্ধান পাওয়ার দাবি করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই জরিপের ফল জানাতে সেগুনবাগিচায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন এ তথ্য জানান। যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) তথ্য মতে, সমুদ্রের তলদেশে গ্যাস ও পানির সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া স্ফটিককে গ্যাস হাইড্রেট বলা হয়। এটা দেখতে বরফের মতো হলেও এতে প্রচুর পরিমাণে মিথেন থাকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কেবল গ্যাস হাইড্রেটই নয়, জরিপে বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক শৈবালেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। যা মাছ ও পশুখাদ্যের কাঁচামাল এবং সাবান ও শ্যাম্পুর মতো প্রসাধনী পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য মতে, মাছ, পশুখাদ্য এবং সাবান-শ্যাম্পুসহ প্রসাধনী পণ্য উৎপাদনে প্রতিবছর প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার শৈবাল জাতীয় কাঁচামাল আমদানি করে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরের শৈবাল আহরণ সম্ভব হলে আর যাই হোক বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা কিছুটা হলেও কমবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি এবং ইউনিট সচিব রিয়ার এডমিরাল (অব.) এম খোরশেদ আলমও জরিপের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন। মেরিটাইম সচিব বলেন, সমুদ্র সম্পদ আহরণে বড় আকারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে প্রাথমিকভাবে, আমরা বিদেশি বিনিয়োগ নয় বরং দেশীয় কোম্পানিগুলোকে আমন্ত্রণ জানাতে চাই। সূচনা বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি এখানে আপনাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি দু’টি আনন্দ সংবাদ শেয়ার করার জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে ২০১২ এবং ’১৪ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তির ফলশ্রুতিতে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ তার মূল ভূখণ্ডের ৮১ শতাংশ পরিমাণ রাষ্ট্রীয় জলসীমা অর্জন করে অর্থাৎ সমুদ্রে মোট ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার জলরাশির জলস্তম্ভ, সমুদ্রতল এবং অন্তমৃত্তিকায় বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অর্জন দেশের মেরিন ও উপকূলীয় অঞ্চলে সকল প্রকার সমুদ্র সম্পদ আহরণ, বাণিজ্যিক জাহাজ, জ্বালানি, পর্যটন ইত্যাদি ঘিরে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নকে বেগবান করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক, বাণিজ্যিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ পূর্বক সুনির্দিষ্ট ৯টি খাত চিহ্নিত করে এবং সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে “সুনীল অর্থনীতি উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা” প্রণয়ন করে যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত হয়, যা বর্তমানে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীনে ব্লু-ইকোনমি সেল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। অতীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে একটি প্রকল্পের আওতায় সুনীল অর্থনীতি উন্নয়নের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ নিরূপণে মাঠ পর্যায়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। সমীক্ষায় পেশাজীবী, মৎস্যজীবী, উপকূলীয় জনগণ, উদ্যোক্তা, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সকল অংশীজনদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তা বিশ্লেষণপূর্বক সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতামত এবং সুপারিশ গ্রহণ করা হয়।
এছাড়াও, দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়ার্কশপ এবং সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে নীতি-নির্ধারক, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী এবং সুশীল সমাজের সঙ্গে সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নে করণীয় দিকগুলো নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়। উল্লিখিত সমীক্ষা হতে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নিম্নোক্ত ৯ টি খাতের কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১. সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা; ২. সামুদ্রিক মৎস্যচাষ উন্নয়ন; ৩. বাণিজ্যিক নৌপরিবহনের উন্নয়ন; ৪. সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের বিকাশ সাধন; ৫. অফশোর ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সুনীল বায়োটেকনোলজি গবেষণা ও উন্নয়ন; ৬. জাহাজ নির্মাণ ও রিসাইক্লিং শিল্প সমপ্রসারণ; ৭. স্থিতিশীল জীবিকার জন্য ম্যানগ্রোভের বাস্তুসংস্থানগত সেবা; ৮. সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ; ৯. মেরিন স্পেশিয়াল প্ল্যানিং বাস্তবায়ন। মন্ত্রী বলেন, এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে, অফশোর জ্বালানি ও সুনীল বায়োটেকনোলজি গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে গ্যাস হাইড্রেট ও মেরিন জেনেটির রিসোর্স বিশেষত: সামুদ্রিক শৈবাল এর সম্ভাবনা, উপস্থিতি, প্রকৃতি ও মজুত নির্ণয়ের জন্য দু’টি গবেষণা কার্যক্রম যথাক্রমে যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের সহায়তায় সম্পন্ন করে। মন্ত্রী বলেন, দু’টি গবেষণাই অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং দেশের জন্য আশার বার্তা নিয়ে এসেছে।
সামুদ্রিক শৈবাল বিষয়ক গবেষণালব্ধ প্রাপ্তি: এদিকে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি জানান, ব্লু-বায়োটেকনোলজি খাতের উন্নয়নে রিয়ার এডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলমের নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় মেরিন জেনেটিক রিসোর্স (এমজিআর), যা সমুদ্রের প্রাণিজ ও উদ্ভিদ সংক্রান্ত সকল সম্পদকে বুঝায়, এর উপস্থিতি, সার্বিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তথা বাণিজ্যিকীকরণ যাচাইয়ের কাজ শুরু করে করোনার আগে। কোভিড বাস্তবতায় খানিক বিঘ্ন ঘটলেও প্রায় দু’বছর ধরে চলে ওই গবেষণা কার্যক্রম। যা উল্লেখযোগ্য ফল নিয়ে এসেছে। সমুদ্র এলাকায় মাঠ পর্যায়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। উক্ত গবেষণা হতে বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা এর সার্বিক অবস্থান চিহ্নিত করা, বিবিধ প্রজাতি চিহ্নিত করাসহ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করেন। সেই ফলাফলের ভিত্তিতে সমুদ্রে ২২০ প্রজাতির শৈবাল, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া, ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস ইত্যাদি চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে এ সকল প্রজাতির উপর প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি টেস্ট নেদারল্যান্ডসে সম্পন্ন করেন। করোনার কারণে গবেষণা কার্যক্রমে সাময়িক বিরতির পর ২০২১ সালে সেটি পুনরায় শুরু হয়। উক্ত কার্যক্রমে বিশেষ করে বাংলাদেশে সামুদ্রিক শৈবাল সম্ভাবনা ও বাণিজ্যিকীকরণের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। গবেষণালব্ধ ফলাফলে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশে প্রাপ্ত বহুসংখ্যক প্রজাতির শৈবাল এর মধ্যে কয়েকটি প্রজাতির ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাংলাদেশের ব্লু-ইকোনমিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশে সামুদিক শৈবালের চাষ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। এটি উপকূলীয় জনগণের জন্য সহজ ও নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে সক্ষম, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকর্মীর কর্মসংস্থান হতে পারে।