চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির গ্রামের বাড়িতে জীবনের শুরুতে তার পরিচিতি ছিল ছিঁচকে চোর হিসেবে, একসময় হয়ে ওঠেন রীতিমতো থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। র্যাব ও পুলিশের তাড়ায় একপর্যায়ে পালিয়ে চলে গেলেন দুবাই। সেখানে গিয়ে ধীরে ধীরে তার ভাগ্য খুলতে শুরু করে। বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে নারী পাচার করে সেখানে যৌনব্যবসার জাল বিছিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন রাতারাতি বিত্তশালী। দুবাইতেই বিলাসবহুল চার চারটি হোটেলের মালিক বনে যান তিনি।
দুবাইয়ে নারীপাচার চক্রের মূল হোতা এই আজম খান ঢাকায় হঠাৎ গ্রেপ্তার হওয়ার পর চট্টগ্রামে তার গ্রামের বাড়ির বাসিন্দারা হতভম্ব। একসময় তার ভাবমূর্তির সংকট থাকলেও পরে এলাকায় তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন দানশীল ব্যক্তি হিসেবে। ৬ মাস আগেও আজম খান ফটিকছড়ির বাড়িতে এসে বেশ কিছু ক্লাবের অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে অনুদান দেন।
নারীপাচার ও যৌনচক্রে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়ে সম্প্রতি দুবাই পুলিশ আজম খান সম্পর্কে আরব আমিরাতের বাংলাদেশ দূতাবাসকে অবহিত করে। আরব আমিরাত আজম খানের পাসপোর্টও বাতিল করে দেয়। এরপরই দুবাইতে বাংলাদেশ দূতাবাস পাসপোর্ট রেখে আজম খানকে দেশে পাঠিয়ে দেয়। এক্সিট পাস নিয়ে বাংলাদেশে এসেই তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
আরব আমিরাতের দুবাই থেকে পুলিশের তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সেই ‘গডফাদার’ আজম খানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে কখন ও কোন্ জায়গা থেকে আজম খানকে ধরা হয়েছে সে তথ্য জানায়নি সিআইডি।
এক হাজারেরও বেশি নারীকে কাজ দেওয়ার নামে যৌনকর্মে বাধ্য করতেন আজম খান। সারাদেশ থেকে দালালের মাধ্যমে নারীদের সংগ্রহ করতেন আজম। হোটেলে কাজ দেওয়ার কথা বলে তাদের জোর করে ড্যান্সবার ও যৌনকর্মে বাধ্য করা হতো। একেকজনকে ৫০ হাজার টাকা করে বেতন দেওয়ার কথা বলে ওই নারীদের পাচার করা হয় দুবাইয়ে।
দুবাইয়ে নারীপাচার চক্রে তার আরও দুই ভাই জড়িত রয়েছে। দুবাইয়ে চার তারকাযুক্ত তিনটি ও তিন তারকাবিশিষ্ট একটি হোটেলের মালিক অভিযুক্ত এই আজম খান। তার মালিকানাধীন হোটেলগুলো হলো ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ার।
জিয়া আদর্শ একাডেমীর কেন্দ্রীয় সভাপতি তিনি
যৌবনের শুরুতে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সক্রিয় থাকলেও পরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন আজম খান। জামায়াত-বিএনপি ঘরানার প্রায় সব রাজনৈতিক নেতার সঙ্গেই তার রয়েছে ব্যক্তিগত বিশেষ সম্পর্ক। এমনকি দলীয় শীর্ষ নেতারা দুবাই গেলে আজম খানের হোটেলে আতিথ্য গ্রহণ করতেন।
বছরকয়েক আগে জিয়া আদর্শ একাডেমী নামের একটি সংগঠন তৈরি করে তার কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হন আজম খান নিজে। দুবাই থেকে দেশে আসলে তিনি প্রায়ই এই সংগঠনের ব্যানারে নানা সভা-সমাবেশের আয়োজন করতেন। বিএনপির সিনিয়র নেতারা এসব সভায় উপস্থিত থাকতেন। সর্বশেষ দেশের করোনা সংক্রমণের পর ওই সংগঠনের নামে পোস্টার ছেপে তাতে তারেক জিয়ার নিচে নিজের ছবি দিয়ে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করেন।
চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা কয়েকটি ছবিতে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ১৪ জুলাই বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সভায় মঞ্চে আজম খানের একপাশে সাবেক মন্ত্রী ব্যরিস্টার মওদুদ আহমেদ এবং অন্য পাশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে দেখা গেছে।
গত বছরের ৪ মে একই দাবিতে ঢাকায় জিয়া আদর্শ একাডেমী আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন আজম খান। ওই সভার প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমদ।
আজম খানের সভাপতিত্বে ওই বছরের ২৬ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবে জিয়া আদর্শ একাডেমী এক প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, কৃষক দলের আহ্বায়ক শামসুজ্জামান দুদু, দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রমুখ।
ছিঁচকে চোর থেকে যেভাবে টাকার কুমির
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কেরি মুহুরী বাড়ির মাহবুবুল আলমের ছেলে মোহাম্মদ আজম খান ওরফে মোজাহার প্রথম জীবনে ছিলেন ছিঁচকে চোর। পরে ভিড়েন জামায়াত-বিএনপি সমর্থক দুর্ধর্ষ ক্যাডার ওসমান বাহিনীতে। একপর্যায়ে সেখানে হয়ে উঠেন সেকেন্ড-ইন কমান্ড। ফটিকছড়ি থানায়ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হিসেবে নাম ছিল তার। ২০০৪ সালে নানুপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি কামাল উদ্দিনকে জবাই করে হত্যাসহ অন্তত পাঁচটি হত্যামামলার আসামি আজম খান— জানিয়েছে ফটিকছড়ি থানা সূত্র। এছাড়া অস্ত্র-চাঁদাবাজি-লুটপাট-অপহরণসহ আরও ১০টি মামলা রয়েছে আজম খানের বিরুদ্ধে। ২০০৪ সালে র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানে এলাকায় টিকতে না পেরে দুবাইতে পালিয়ে যান আজম খান। সেখানে গিয়েই ভাগ্য খুলে যায় তার।
সেই থেকে আর পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি আজম খানকে। বাংলাদেশ থেকে দুবাইতে নারীপাচার ও হোটেল ব্যবসা করে বনে যান টাকার কুমির।
চুরির মামলায়ও হয়েছিল ৩ বছরের জেল
২০০৭ সালের ফটিকছড়ি থানায় চুরির এক মামলায় ২০১৫ সালে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন আজম খান। ২০১৮ সালে ফটিকছড়ির বাসিন্দা মালয়েশিয়া প্রবাসী লিয়াকত আলীকে ঢাকায় অপহরণ করে ২০ কোটি টাকার চেকে স্বাক্ষর নেন জোর করে। পরে লিয়াকত আলী থানায় মামলা দায়ের করেন।
লিয়াতক আলী বলেন, ‘ব্যবসার কথা বলে আমার কাছ থেকে পাঁচ কোটি টাকা নেন আজম খান। যৌথভাবে ব্যবসা চালু করবে এ শর্তে আমি টাকাগুলো দিই। কিন্তু সে আমার সাথে প্রতারণা করেছে। উল্টো আমাকে ঢাকা থেকে অপহরণ করে চেক ছিনিয়ে নেয়। আজম খানের লোকেরা ঢাকা থেকে আমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। পরে সেখানে দেখা করে আজম।’
মা জানেন, দুবাইতে ফলফ্রুটের ব্যবসা ছেলের
ফটিকছড়িতে আজম খানের বাড়িতে গেলে তার প্রতিবেশীরা জানান, সেখানে তিন তলা বিশিষ্ট তার বিলাসবহুল বাড়িটি নির্মাণে প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।
স্থানীয় আহমদ গণি বলেন, ৬ মাস আগে আজম খান ফটিকছড়ির বাড়িতে আসেন। এ সময় এলাকায় তিনি বেশ কিছু ক্লাবের খেলাধুলায় অতিথি হয়ে কিছু অনুদানও দেন।
ফটিকছড়ির বাড়িতে আজমের মা ও স্ত্রীকে পাওয়া যায়। মা ছবিলা খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমার ছেলে দুবাইতে ফলফ্রুটের ব্যবসা করে।’
আজমের স্ত্রী সেলিনা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীর বিরুদ্ধে নারী পাচারের যে কথা শুনছি সেই বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। সংসার জীবনে কখনও অনুমানে করতে পারিনি।’
ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাবুল আক্তার বলেন, ‘ফটিকছড়ির আজম খানকে ঢাকায় গ্রেফতারের কথা সংবাদমাধ্যমে শুনেছি। থানায় তার বিরুদ্ধে কোন মামলা তদন্তাধীন নেই। তবু আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।’
ফটিকছড়ি উপজেলা বিএনপির আহবায়ক সরোয়ার আলমগীর বলেন, ‘আজম খান নামে কেউ আমাদের ফটিকছড়ি বিএনপির সাথে জড়িত নেই। এ ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহী ব্যক্তির যথাযথ বিচার হোক।’
উৎসঃ চট্টগ্রাম প্রতিদিন