‘নদীতে ঘর-বাড়ি ভাঙ্গে গেলে এই এলাকায় আইসা ঘর তুলছিলাম। চেয়ারম্যান আইসা কইলো, আপনি ঘর ভাইঙ্গা দ্যান, আপনারে একটা ঘর দেবানে। খরচের জন্য তিনি ২৫ হাজার টাকা নিয়েছেন,’ দ্য ডেইলি স্টারকে কথাগুলো বলেন মুজিববর্ষের উপহারের ঘর পাওয়া ৫২ বছর বয়সী ভূমিহীন কৃষক দুদু মোল্লা। তিনি ঘর পেয়েছেন ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রির চর ইউনিয়নের পদ্মার ওপারে পালডাঙ্গী এলাকায়।
ফরিদপুরের ধরার মোড় থেকে পদ্মা পার হয়ে প্রায় পাঁচশ মিটার পার হলেই পালডাঙ্গী এলাকায় চোখে পড়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেওয়া ঘরগুলো। সেখানে ২৪ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১২টি ঘর।
এসব ঘরের বাসিন্দারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ডিক্রির চর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান ঘর দেওয়ার জন্য প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে ২৫ হাজার করে টাকা করে নিয়েছেন। পাশাপাশি জমির মাটি ভরাট, দলিল তৈরি, টিউবওয়েল মেরামত ও বৈদ্যুতিক সংযোগের জন্যেও আলাদা করে টাকা দিতে হয়েছে।
কয়েক কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করে দুয়েক মাস আগে তারা ঘরে উঠেছেন। এর মধ্যেই ঘরগুলো তাদের কাছে বসবাসের অযোগ্য বলে মনে হতে শুরু করেছে।
দ্য ডেইলি স্টারকে নতুন ঘরে থাকার অভিজ্ঞতার কথা জানান দুদু মোল্লা। তিনি বলেন, ‘এখনই ঘরের টিনের স্ক্রুর ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে। বৃষ্টির সময় ঘর-বাহির একাকার হইয়া যায়। টিনের কার্নিশ নাই, বাথরুমের বৃষ্টির ঝাপটার পানি ঘরের ভেতরে ঢোকে।’
একটি ঘরে থাকেন নুরুদ্দীন মোল্লার বিধবা স্ত্রী ছবি বেগম (৬২)। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বৃষ্টি হলে ঘরে থাকা যায় না, পানি পড়ে। ঘরের যে অবস্থা কখন ভাইঙ্গা পড়ে, সেই ভয়ে থাকি সব সময়।’
ঘর নেওয়ার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এই টাকা নাকি ক্যারিং খরচের জন্য লাগছে।’
অন্য এক ঘরের বাসিন্দা রিকশা চালক তোতা মিয়া (৬১) বলেন, ‘বৃষ্টি নামলে টয়লেটের পানি ঘরের মধ্যে চলে আসে। বারান্দার থেকে মেঝে নিচু হওয়ায় বৃষ্টির পানি বারান্দা দিয়ে ঘরের মধ্যে চলে আসে।’
ডিক্রির চর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসানের কাছে টাকা নেওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পদ্মার ওপারে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দিতে ইউএনও রাজি ছিলেন না। আমিই বলে কয়ে বরাদ্দ করেছি। কিন্তু নির্মাণ সামগ্রী ওই জায়গায় নেওয়ার ব্যাপারে কোনো ক্যারিং কস্ট (পরিবহন খরচ) বরাদ্দ ছিল না। এজন্য উপকারভোগীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘২৫ হাজার করে টাকা চাওয়া হয়েছিল। ওই টাকা কেউ কেউ দিয়েছে, কেউ কেউ দেয়নি, আবার কেউ কেউ কম দিয়েছে। সবার হিসাবই আমার কাছে লেখাজোকা আছে। আমি নিজে কোনো টাকা ধরিনি।’
আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, ঘরগুলো নির্মাণে অনুসরণ করা হয়নি সরকারি নকশা। ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী।
সরকারি ঘর পাওয়া সোনিয়া বেগম (২১) বলেন, ‘যে জায়গায় ঘর করে দেওয়া হয়েছে, সে জায়গাটি অনেক নিচু ছিল বলে মাটি ভরাটের জন্য ১৪ হাজার ও ঘরের জন্য ২৫ হাজার মোট ৩৯ হাজার টাকা দিতে হয়েছে মেহেদী চেয়ারম্যানকে।’
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১২টি পরিবারের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে একটিমাত্র টিউবওয়েল। সেটাও পড়ে আছে অকেজো হয়ে, পানি ওঠে না। টিউবওয়েল মেরামতের জন্য চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করলে তিনি আবারও প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে ৯০০ টাকা করে দাবি করেছেন।
বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ঘর প্রতি দুই হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে পল্লী বিদ্যুতের লোকজনদের। তারপরও আসেনি বিদ্যুৎ সংযোগ। এছাড়া ঘরের দলিল বাবদ প্রত্যেককে দিতে হয়েছে এক হাজার ২০০ টাকা করে। অথচ বুঝে পাননি দলিল।
অনিক হাসান (২৪) নামে এক যুবক বলেন, ‘চেয়ারম্যান ২৫ হাজার টাকা নিয়ে আমার দাদি রহিমা বেগমের নামে একটি ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন। ঘরটি খুব নিম্নমানের ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। কাজ করার সময় প্রতিবাদ করলেও কোনো কাজে আসেনি।’
তাছাড়া ঘরগুলি করা হয়েছে নরম বালু-মাটির ওপর। বৃষ্টি হলে ধসে পড়তে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কয়েকটি ঘরের বারান্দায় ফাটল ধরেছে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়ির রান্নাঘর ও টয়লেটের অংশটি নির্ধারিত নকশার চেয়ে কমপক্ষে এক ফুট কম জায়গায় তৈরি করা হয়েছে। এতে প্রতিটি বাড়ি নির্মাণে অন্তত ২৫০টি ইট ও অন্যান্য উপকরণ কম লেগেছে।
এছাড়া ঘরের মেঝের দিকে তাকালে চোখে পড়ে বালির আধিক্য। ইতোমধ্যে খড়ে পড়েছে পলেস্তারা। কয়েকটি বাড়ির বারান্দায় ফাটলও দেখা গেছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত পাঁচ মাস আগে এই ঘরগুলোর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শেষ হয়েছে গত দুই মাস আগে।
ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রথম ধাপে ৩১২টি এবং দ্বিতীয় ধাপে ১৫৩টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ডিক্রির চর ইউনিয়নের এই ১২টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে।
এই ঘরগুলো নির্মিত হয়েছে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুম রেজার তত্ত্বাবধানে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সব কাজ নজরদারি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এলাকাবাসীর কাছ থেকে ইউপি চেয়ারম্যান টাকা নিয়েছেন এ অভিযোগ আমাকে কেউ দেয়নি।’
তিনি সরেজমিনে গিয়ে বিষয়গুলো দেখবেন বলে জানান।
উৎসঃ দ্য ডেইলি স্টার