
মঈন নাসের খাঁন, কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি: দুই দশকের বেশি সময় ধরে কুমিল্লা নগরীতে একের পর এক ভরাট হয়ে গেছে বেশির ভাগ পুকুর ও ডোবা। এবার পরিবেশ ও জলাধার সংরক্ষণ আইনের কোনো তোয়াক্কা না করেই ভরাট হচ্ছে কুমিল্লার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন জলাশয় হাতিপুকুর।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর এলাকায় অবস্থিত হাতিপুকুর ভরাট বন্ধ এবং রক্ষার দাবিতে এরই মধ্যে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে এলাকাবাসী। স্থানীয়রা জানিয়েছে, প্রতিবাদের পরও ভরাটকারীরা রাতের আঁধারে কৌশলে একটু একটু করে পুকুরটি ভরাট করছে।
গত ৫ জুন কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আলোচনাসভায় হঠাৎ হাতিপুকুর ভরাটের প্রতিবাদে ও পুনরায় পুকুরটি খনন করে দখলদারদের হাত থেকে অবমুক্ত করার দাবিসংবলিত ব্যানার নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে ঢুকে পড়ে অর্ধশত প্রতিবাদী নারী-পুরুষ। পরে তারা জেলা প্রশাসকের দফতারের নিচতলায় মানববন্ধন করে ও জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দেয়।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, হাতিপুকুরটি দুই একর ৩৭ শতকের। এর দক্ষিণ অংশের মালিক কুমিল্লা বঙ্গবন্ধু আইন কলেজের অধ্যক্ষ আইনজীবী আলী আজাদের পরিবার ও উত্তর অংশের মালিক ১৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল জলিলের পরিবার।
সম্প্রতি পুকুরের উত্তর অংশের ১২ শতকের বেশি জায়গা ভরাট করা হয়েছে। এর আগেও পুকুরের কিছু অংশ ভরাট করে দোকানপাট করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুকুরটি আমাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি। কয়েক বছর আগে পুকুরের উত্তর অংশে ময়লা ফেলতে শুরু করে স্থানীয় এলাকাবাসী।’
তখন সেখানে ময়লার স্তূপ পড়ে গেলে আমরা সেখানে দোকান করি। আর বর্তমানে আমরা পুকুরের পার বাঁধছি, ভরাট করছি না।’
আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘মূলত বিএনপির কিছু ছেলেপেলে মিলে এই আন্দোলন করছে। ওরা আমার কাছে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে।’ স্থানীয় বাসিন্দা লিটন মিয়া, রাশেদা বেগম, নাইম মিয়াসহ কয়েকজন জানান, ছয় মাস আগে পুকুর সেচে রাতে কৌশলে ভরাটের কাজ শুরু হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসীর দাবি, মানুষের পানির কষ্ট দূর করতে প্রায় ২৫০ বছর আগে ত্রিপুরার রাজারা পুকুরটি খনন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে কালক্রমে পুকুরটি লিজ দেওয়া হতো। ধীরে ধীরে একটি চক্র পুকুরটি নিজেদের নামে করে ফেলে।
পুকুরের পশ্চিম পারের বাসিন্দা ৮০ বছরের বৃদ্ধা আঞ্জুমা বেগম বলেন, ‘আমার বাবা-দাদা এই পুকুরে গোসল করতেন। আমার স্বামীও এখানে গোসল করতেন। তবে এখন আমার ছেলে-মেয়েরা গোসল করার মতো পরিস্থিতি নেই। ময়লা পানিতে কেউ নামলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর এখন তো পানি সরিয়ে পুকুর ভরাট করা হচ্ছে।’
পুকুরের দক্ষিণ পারের বাসিন্দা বেলা রাণী সাহা জানান, কয়েক মাস আগে পাশের তেলিকোনা এলাকায় আগুন লাগলে হাতিপুকুরের পানি নিয়ে নেভানো হয়। সেদিন পুকুরটি না থাকলে পুরো এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ত।
পুকুরপারের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, ‘স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল এই পুকুর ভরাট করছে। তাদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না।’
পরিবেশ অধিদফতর, কুমিল্লার উপপরিচালক মোসাব্বের হোসেন মুহাম্মদ রাজীব বলেন, ‘কোনোভাবেই পুকুর ভরাট করতে দেওয়া হবে না। কেউ ভরাট করতে চাইলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), কুমিল্লার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা চাই পুকুরটি রক্ষায় যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, ‘এই পুকুরটি রক্ষার জন্য স্থানীয়রা স্মারকলিপি দিয়েছে। আমরা বিষয়টি দেখছি। বেআইনিভাবে পুকুর ভরাট করতে দেওয়া হবে না।’