কোরবানির ঈদের বাকি নেই আর দুই সপ্তাহও। ফলে দেশজুড়ে কোরবানিদাতাদের মধ্যে পশু কেনার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে কোরবানির পশুর হাটে যেতে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই। স্বাভাবিক সময়ের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সচেতন বেশিরভাগ মানুষেরই মনে হচ্ছে এসব হাটে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে করোনার সংক্রমণ এড়ানো যাবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। এমন পরিস্থিতি মাথায় রেখে রাজধানীর পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় প্রশাসনের উদ্যোগে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এজন্য অনেক জেলা প্রশাসন নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছে ওয়েবসাইট ও অ্যাপ। অনেক জায়গায় ওয়েবসাইট তৈরি সম্ভব না হওয়ায় দেশে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পেজ খোলা হয়েছে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। আছে ব্যক্তিগত উদ্যোগও। যতটা শঙ্কা ছিল খামারিদের সাড়া তার চেয়েও বেশি। প্রশাসন ও খামারিদের প্রত্যাশা, ঈদের আগে প্রতিদিনই এসব ওয়েব পোর্টাল, অ্যাপ ও ফেসবুক শপের পরিচিতি বাড়বে।
সভায় জানানো হয়, গত বছর নরসিংদী জেলাজুড়ে ৬২টি কোরবানির অস্থায়ী পশুর হাট বসানো হলেও এবছর ছয় উপজেলায় তা কমিয়ে ২১টি হাট বসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এসব কোরবানির হাটে পশু বিক্রির পাশাপাশি ক্রেতারা ঘরে বসে অনলাইনে এই ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে পশু কিনতে পারবেন। মূলত স্বাস্থ্যবিধি না মেনে পশুর হাটে ক্রেতাদের ভিড় জমানো নিরুৎসাহিত করতেই এই ডিজিটাল হাটের আয়োজন।
ওই সাইট ও অ্যাপসে খামারির নাম, পশুর ছবি, আকার, রঙ, ওজন, উচ্চতা, দাঁত, জাত, দাম, বয়স এবং মুঠোফোন নম্বর দেওয়া থাকবে। এছাড়া এসব অনলাইন প্ল্যাটফর্মে থাকছে উপজেলাভিত্তিক কসাইদের নামের তালিকা। ঈদের তিনদিন আগে ওই কসাইদের করোনা পরীক্ষা করানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ক্রেতাদের সুবিধার্থে এমন ২৬টি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এসব ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপসে।
অনলাইনে কোরবানির পশু বেচাকেনা দেশে গত তিন-চার বছর ধরেই হচ্ছে। তবে এতদিন এসব ছিল কেবলই ব্যক্তিগত উদ্যোগ। মূলত রাজধানী কেন্দ্রিক এসব হাট ছিল সুনির্দিষ্ট কিছু খামারির। ঈদের মূল কোরবানির হাটে বলতে গেলে এর তেমন কোনও প্রভাবই ছিল না। তবে এবার করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে পশু বিক্রির প্ল্যাটফর্ম তৈরির বিষয়ে সরকারের মনোযোগ থাকায় এবার সারাদেশেই এর সাড়া পড়বে বলে সচেতনমহল আশাবাদী। আর তা করতে পারলে ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে, যা দেশকে ডিজিটাল দেশে রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
‘‘জনবহুল স্থান এড়িয়ে চলি, ‘পশুর হাট’ অ্যাপসে পশু ক্রয়-বিক্রয় করি’’-এমন প্রতিপাদ্য সামনে নিয়ে শনিবার আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে সিরাজগঞ্জে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলার জন্য ‘ডিজিটাল পশুর হাট ক্রয়-বিক্রয় অ্যাপ’-এর উদ্বোধন করা হয়েছে। মোবাইল অ্যাপ সেবার মাধ্যমে দেশের সকল খামারির পশু কেনাবেচার সুবিধার জন্য এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে এর মাধ্যমে।
গত ১৩ জুলাই জুম কনফারেন্সের মাধ্যমে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অ্যাপটি উদ্বোধন করেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার। এসময় রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ও ৮ জেলার জেলা প্রশাসকগণ অনলাইন জুম অ্যাপসের মাধ্যমে সংযুক্ত হন। সিরাজগঞ্জ প্রান্তে তখন জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদসহ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তারা ছিলেন।
উদ্বোধন শেষে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘করোনাকালীন দেশের এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনও বিকল্প নেই। করোনার ফলে সারা বিশ্বে একদিকে যেমন অনেক মানুষ কাজ হারাচ্ছে, তেমনি তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর অনেক নতুন পেশা ও কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের এ পরিস্থিতিতে অনলাইনে কোরবানি পশু বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় খামারিরা ন্যায্যমূল্যে তাদের গরু-ছাগল বিক্রি করতে পারবেন। মানুষ যাতে প্রতারিত না হয়, সেজন্য জেলা প্রশাসন, প্রাণিসম্পদ দফতর এবং পুলিশ বাহিনীর সমন্বয়ে পশু ক্রয়-বিক্রয়ের এ ডিজিটাল কার্যক্রম তদারকির জন্য পরামর্শও দেন তিনি। এছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর এ সেবাকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে কাজে লাগানো এবং স্থানীয় পত্রিকায় বহুল প্রচার ও প্রচারণা চালানোর জন্য আহ্বান জানান তিনি।
জানা গেছে, পশু বিক্রির ক্ষেত্রে দরকারি সব সুবিধাকেই এই অ্যাপের মধ্যে যুক্ত করা হয়েছে। আর এই অ্যাপের উদ্ভাবক সিরাজগঞ্জ জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান। তিনি রবিবার (১৯ জুলাই) বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘পশুর হাট’ অ্যাপটি শুধু কোরবানির ঈদের জন্য করা হয়নি, এই অ্যাপটি এমনভাবে ডেভেলপ করা, যেন এটি সারা বছরই আমাদের দেশের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে, প্রান্তিক পর্যায়ের সকল খামারির (হাঁস, মুরগি, গরু-ছাগল, মাছ এমনকি সবজি চাষিসহ সকল শ্রেণির খামারির কথা মাথায় রেখে) জন্য অ্যাপটি ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ বলেন, শুরুতে শুধু সিরাজগঞ্জ কেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা বা পরিকল্পনা করা হলেও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার মহোদয়ের নির্দেশে ৮টি জেলা নিয়ে পরে এর ব্যাপ্তি বা কর্মকাণ্ড শুরু করা হয়। গত ক’দিনে দেশের অন্যান্য জেলা থেকে এ অ্যাপে সংযুক্ত হতে অনেকে ইচ্ছা পোষণ করছেন।
ওই অনুষ্ঠানে বলা হয়, পশু ক্রয় বা বিক্রয় করার জন্য সব ধরনের তথ্য, নির্দেশিকা ও সহায়তা এ অ্যাপসটির মাধ্যমে পাবেন সব শ্রেণি পেশার মানুষ। খামারি জনগোষ্ঠীকে প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে স্মার্ট খামারি তৈরিতে ‘পশুর হাট’ অ্যাপটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে যে কোনও জেলার পশু পালন কর্মকর্তাদের সহায়তায় প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে পশুর বিস্তারিত তথ্য সরাসরি দেওয়া হবে এই অ্যাপে। ফলে হাটে না গিয়েও নিজ নিজ এলাকার খামারিরা পশুর ছবি, ভিডিও, উচ্চতা, ওজন, বয়সসহ বিভিন্ন তথ্য দিয়ে অনলাইনে পশু বিক্রি করার সুযোগ পাবেন এর মাধ্যমে।
এভাবে বিভিন্ন জেলাতেই চলছে অ্যাপের মাধ্যমে গরুর হাট। চুয়াডাঙ্গা জেলায় https://foodfornation.gov.bd/ নামে অনলাইন হাটে শুরু হয়েছে কোরবানির গরু বিক্রির কার্যক্রম। সরকারি এই ওয়েবসাইটটি সম্প্রতি চালু হয়েছে। জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে অনলাইন গরুর হাটটি পরিচালিত হচ্ছে।
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এটি মূলত স্টার্টআপ বাংলাদেশ ও একশপ এর যৌথ উদ্যোগ যা সরকারের ডিজিটাল হাট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মটি সারাবছরই চালু থাকে এবং সব ধরনের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা যায় এখানে। কোরবানি উপলক্ষে গরু বেচাকেনার জন্য এখানে একটি আলাদা ট্যাব যুক্ত করা হয়েছে। এই ট্যাবে ঢুকে হাটের দামি গরুগুলো তো সহজে চোখে পড়েই ক্রেতা তার বাজেট নির্দিষ্ট করে দিলেও চলে আসে সেই বাজেটে প্রদর্শিত গরুগুলো। একইভাবে ছাগল ভেড়া মোষ এজাতীয় পশুও এখানে খুঁজে বের করা যায় সহজেই। ফলে যেকোনও ক্রেতা একবার এই হাটে প্রবেশ করলে তার কাঙ্ক্ষিত মূল্যে কী ধরনের গরু আছে তা ঘরে বসেই দেখতে পারছেন।
জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, এ জেলার সব উপজেলাতেই অনলাইন গরুর হাটের ব্যাপারে অবহিত করানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে সকল ইউনিয়ন পরিষদ ও ৪টি পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারি ও গরু-মহিষ এবং ছাগলের তথ্য সংগ্রহ করে সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশের জন্য।