রাউজানের গহিরা এলাকার আসাদুজ্জামান। ২৭ জুলাই সোমবার সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এবং দুপুর আড়াইটায় ঢাকা থেকে দুবাইগামী ফ্লাইট ছিল তার।
২৬ জুলাই রোববার বিকেল ৩টায় করোনা সনদ পাওয়ার কথা। বিকেল গড়িয়ে রাত হয়েছে, রাত কেটে সকাল- ১৮ ঘণ্টা অপেক্ষার পরও করোনা সনদ পাননি তিনি।
প্রায় ২২ ঘণ্টা পর দুপুর ১২টার দিকে তিনি যখন করোনা সনদ পেলেন, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইট তখন উড়াল দিয়েছে।
তার পরও আসাদুজ্জামান প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন বিমানবন্দরে, যদি কোনো একটা ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছে দুপুর আড়াইটায় দুবাইয়ের বিমানটা ধরা যায়! বিধিবাম। কোনো বিমানেই আসন খালি নেই। তাই তিনি যেতে পারেননি ঢাকা, যাওয়া হয়নি কর্মস্থল দুবাইয়েও।
আসাদুজ্জামান যখন দুপুরে ছুটছিলেন চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের দিকে, তখন কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে দেশে এসে করোনার কারণে আটকে যাই। আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত ভিসার মেয়াদ আছে। অথচ ঈদের আগে দুবাইয়ের কোনো ফ্লাইটেই আসন খালি নেই। জানি না কর্মস্থলে আর ফিরতে পারব কিনা।
যদি যেতে না পারি তাহলে সামনে কী করব, কী খাব- সেই চিন্তায় মরে যাচ্ছি।
আমাদের রেমিট্যান্সযোদ্ধা বলা হয়, অথচ সব জায়গায় আমরাই সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার।
করোনাভাইরাস সনদ পেতে কেন এত ঝামেলা হলো? দেরি হলো? এর দায় কার?’
গতকাল সোমবার যথাসময়ে করোনা সনদ না পাওয়ায় চট্টগ্রামের অর্ধশতাধিক বিদেশগামী যাত্রী ফ্লাইট মিস করেছেন।
গত রোববার বিকেল ৩টা থেকে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিসে অপেক্ষা করে, খোলা আকাশের নিচে নির্ঘুম রাত কাটিয়েও সকালে নির্ধারিত ফ্লাইটের আগে রিপোর্ট পাননি তারা। রিপোর্ট না পেয়ে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যারা পেয়েছেন, তারাও সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন।
ফ্লাইট ধরার জন্য এক কাপড়েই অনেককে ছুটতে হয়েছে বিমানবন্দরে। দেখা করা হয়ে ওঠেনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।
চট্টগ্রামে বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষার নমুনা প্রদান ও রিপোর্ট পাওয়া নিয়ে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে।
একটি মাত্র ল্যাব ফৌজদারহাট বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশান ডিজিসেসে (বিআইটিআইডি) বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়ায় নমুনাজট ও রিপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছে। রোববার বিআইটিআইডি থেকে ২৮১ জনের রিপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও যথাসময়ে রিপোর্ট আসে মাত্র ৬৭টি। বিআইটিআইডি কর্তৃপক্ষের অবহেলা, ল্যাবে কর্মরতদের অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতার কারণে গত রোববারের করোনা পরীক্ষায় হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর আগে ২১ জুলাই চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের বুথে নমুনা দিতে এসেও চরম দুর্ভোগে পড়েন বিদেশগামীরা।
দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে, বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে করোনা পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করতে পেরেছিলেন মাত্র ২৯৪ জন।
সেখানে সামাজিক দূরত্বের বালাই ছিল না। পরীক্ষা করতে এসেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছিলেন অনেক বিদেশগামী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী এ ব্যাপারে বলেন, ‘চট্টগ্রাম যে একটা নামসর্বস্ব বাণিজ্যিক রাজধানী, সেটা করোনাকালে আরও পরিস্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে। করোনা চিকিৎসায় চট্টগ্রামের মানুষ চরম দুর্ভোগ সহ্য করেছে।
এখন বিদেশগামীরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। চট্টগ্রামের বেশিরভাগ রেমিট্যান্সযোদ্ধা মধ্যপ্রাচ্যেই থাকেন।
তারা ঠিক সময়ে কর্মস্থলে ফিরতে না পারলে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে।
প্রবাসীরা যেন নির্বিঘ্নে করোনা পরীক্ষা করাতে পারেন এবং ঠিক সময়ে বিদেশ যেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা এখনই করা হোক।’
হাটহাজারী কলেজ গেট এলাকার আলমগীর তালুকদার বলেন, ‘সোমবার সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আমার ফ্লাইট ছিল।
ঢাকা থেকে দুপুর আড়াইটায় একই বিমানে দুবাইগামী ফ্লাইট ছিল। অথচ আমি করোনা সনদ হাতে পেয়েছি নির্ধারিত সময়ের ২৩ ঘণ্টা পর, দুপুর ১টায়।
ফলে দুটি ফ্লাইটই মিস করেছি। জানি না আমরা প্রবাসীরা কী অপরাধ করেছি, আমাদের সঙ্গে এ কেমন আচরণ!’
আনোয়ারার নাজিমুদ্দিন বলেন, ‘গত রোববার বিকেল ৩টা থেকে অপেক্ষায় ছিলাম, ১৮ ঘণ্টা পর রিপোর্ট পেয়েছি।
ফলে এক কাপড়ে বিমানবন্দরে ছুটতে হচ্ছে, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে দেখাটাও করতে পারলাম না।
চট্টগ্রামে বিদেশগামীদের জন্য শুধু একটি ল্যাবেই পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে সরকার। আরও দু-একটি ল্যাবে পরীক্ষার অনুমতি দিলে এই অবস্থা হতো না।’
চট্টগ্রামে সাধারণ রোগীদের নমুনার সংখ্যা কমছে, তার পরও একটিমাত্র ল্যাবে কেন বিদেশগামীদের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে সিভিল সার্জন বলেন, ‘বিদেশগামীদের নমুনার সংখ্যা বাড়লে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও পরীক্ষার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পরে নমুনার সংখ্যা কমে যাওয়ায় তা আর করা হয়নি। তবে রোববারের ঝামেলাটা ঘটেছে সার্ভারের।’
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘সার্ভারের সমস্যার কারণে বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দিতে দেরি হয়েছে।
রোববার ২৮১ জনের রিপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও রিপোর্ট আসে মাত্র ৬৭টি। এর মধ্যে কিছু রিপোর্ট ছিল ডাবল। এগুলো ঠিক করতেও সময় লেগেছে।’
সূত্রঃ সমকাল