দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি প্রবাসী আয়। এই আয়ের ওপর ভর করে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু বিভিন্ন প্রণোদনার পরও কমছে প্রবাসী আয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একটি বড় অংশ হুন্ডিতে আসার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমছে।
গত অর্থবছরে (২০২১-২২) রেমিট্যান্স কমেছে ৩৭৫ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) থেকে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, গেল ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। সে হিসাবে (২০২০-২০২১) অর্থবছরের চেয়ে গেল অর্থবছরে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ রেমিট্যান্স কম এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি জুলাইয়ের প্রথম ২১ দিনে ১৬৪ কোটি ২৮ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশীয় মুদ্রায় বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা) যা প্রায় ১৫ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন এসেছে ৭৪৩ কোটি টাকা। আর গত জুনে এসেছিল ১৮৩ কোটি ৭২ লাখ ডলার। যা তার আগের মাসের চেয়ে ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার কম।
চলতি বছরের মে মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। গত বছর মে মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ১৯৪ কোটি ৮ লাখ ডলার। সে হিসাবে দেখা যায় রেমিট্যান্স প্রবাহ লাগাতার কমছেই।
রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার কারণ হিসাবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ হুন্ডিতে আসার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে গেছে। এছাড়া ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দামে ব্যবধান অনেক বেশি থাকার কারণেও অনেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে চান না। বর্তমানে খোলাবাজারে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েই চলেছে। গত রবিবারে তুলনায় গতকাল ডলারের দাম বেড়েছে দেড় টাকা। প্রতি ডলার ১০৫ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
রাজধানীর মানি চেঞ্জার ও খোলাবাজার থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, মার্কিন ডলারের দাম ঈদের আগে ও পরে ১০০ থেকে ১০২ টাকার মধ্যে বেচাকেনা চলছিল। কিন্তু এখন সেটি বেড়ে ১০৫ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ১০৫ টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে বেচাকেনা হচ্ছে।
মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডলারের দাম ১০৫ টাকা ৫০ পয়সাও ছাড়িয়ে গেছে।
জামান মানি এক্সচেঞ্জ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা ডলার ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা ও ১০৫ টাকা দরে কিনছি। বিক্রি করছি ১০৫ টাকা ৫০ পয়সা দরে। এখন পর্যন্ত ৫০ থেকে ৭০ পয়সা ব্যবধানে বেচাকেনা চলছে।’
গতকাল সকালে ডলার ১০৪ টাকা ১০ পয়সা করে কিনে ১০৪ টাকা ৪০ পয়সা দরে বিক্রি হয়েছে। দুপুরের পর ডলার ১০৫ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ১০৫ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানান মতিঝিলের দিলকুশায় অবস্থিত যমুনা মানি এক্সচেঞ্জের পরিচালক মো. রাজু।
তিনি জানান, ডলারের সংকটের কারণে কেনা সম্ভব হচ্ছে না। যাও পাওয়া যাচ্ছে, বিক্রেতারা বেশি দাম চাচ্ছেন।
আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলেও ডলারের দাম বেড়ে গেছে। রপ্তানি বাড়লেও প্রবাসী আয় কমেছে। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে গত বৃহস্পতিবার থেকে প্রতি ডলারের জন্য খরচ করতে হচ্ছে ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা।
গত এক মাসের ব্যবধানে আন্তঃব্যাংকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ।
খোলাবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই সপ্তাহ আগে ৯৮ টাকা ডলার প্রতি বিক্রি হলেও গত সপ্তাহের শুরুতে এর দাম ওঠে ১০০ টাকা। গত বুধবার ডলার বিক্রি হয় ১০২ টাকা ৬০ পয়সা পর্যন্ত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এরপর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়। যা এখনও অব্যাহত আছে।
খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি থাকায় প্রবাসীরা হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠাতেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আগামী দিনে বাড়বে বলে তারা মনে করে।
এদিকে রেমিট্যান্স কমায় দেশের রিজার্ভেও চাপ পড়েছে। কেননা মোট আমদানি ব্যয়ের ৪০ শতাংশ রেমিট্যান্স থেকে জোগান দেওয়া হয়। রেমিট্যান্স কমায় এখন ডলারের জোগানও কমে গেছে। ফলে বাজারে ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ডলারের দাম বেড়ে কমে যাচ্ছে টাকার মান।
বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমজীবী মানুষের কষ্টার্জিত বৈদেশিক আয় বৈধ উপায়ে দেশে আনার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রণোদনা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় অর্থমন্ত্রণালয়। তখন থেকেই তারা প্রণোদনা পান দুই দশমিক পাঁচ, অর্থাৎ আড়াই শতাংশ হারে। যা প্রথম জানুয়ারি থেকেই কার্যকর হয়েছে।
অর্থমন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, মানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের গুরুত্ব আছে।