গত এক দশক ধরে নানা সময়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জনমানুষের কাছে সহজ করে দেওয়ার কাজ করছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ডা. ফেরদৌস খন্দকার। কখনও অনলাইনে, কখনও অফলাইনে। দেশের বাড়ির এলাকায় আছে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র। চলছে ইউটিউবে চ্যানেলের মাধ্যমে নানা চিকিৎসা পরামর্শ। আর এসব করতে কয়েক মাস পরপরই তিনি দেশে আসতেন জানিয়ে বুধবার দেশত্যাগের আগে বারবারই বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন ছুড়ে দিতে থাকেন তিনি– এবারই কেন আটকানো হলো? তার চিকিৎসক বন্ধুরাও একই প্রশ্ন তুলে বলছেন, ‘ও কারও ক্ষতি করতে আসেনি। এইবার আমরা তাকে কাজ করতে না দিয়ে যে উদাহরণ তৈরি করলাম তা বিপদে সাহায্যে এগিয়ে আসা মানুষদের আগামীতে দ্বিধান্বিত করবে। মানুষ কারও জন্য কিছু করতে ভয় পাবে।’
নিউ ইয়র্কের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ফেরদৌস কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর সেখানে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছিলেন। নানা বিষয়ে আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বার্তা দিয়ে দেশের ও দেশের বাইরের বাঙালি জনতাকে সচেতন করতে বাংলা কনটেন্ট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এই সাড়া ফেলার মধ্যে হঠাৎই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে সামনে আসে নানা নেতিবাচক তথ্য। এই নেতিবাচক প্রচারণা ঠেকাতে তাকে শিক্ষাজীবন থেকে যারা জানেন তারা তার রাজনৈতিক পরিচয়, তার কাজের ধরন ও কাজের উদ্দেশ্য বিষয়ে সাক্ষী দিতে হাজির হন। এরই মধ্যে ৭ জুন কাতার এয়ারওয়েজের একটি বিশেষ ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় পৌঁছান ডা. ফেরদৌস। ওই ফ্লাইটের ১২৯ জন যাত্রীর মধ্যে একমাত্র তাকে পাঠানো হয় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন। ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শেষে তিনি গত বুধবার (২৪ জুন) দেশত্যাগ করেন।
অনলাইনে ডা. ফেরদৌসের সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। ভীষণরকম সাহসী এই মানুষটি কিছু সময় একা থাকতে দিতে গণমাধ্যমের কাছে অনুরোধ জানান। পরে তিনি নিজেই যোগাযোগ করবেন বলে জানান।
আটক পণ্য ফেরত নেননি ডা. ফেরদৌস। করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষের জন্য তিনি বেশকিছু পণ্য নিয়ে এসেছিলেন, যা বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। ঢাকা কাস্টম হাউসের উপ-কমিশনার মো. সরওয়ার বলেন, ‘করোনাভাইরাস প্রতিরোধে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি, মাস্ক, সুরক্ষা পোশাকসহ ১২ ধরনের পণ্য আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক-কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, আমদানির আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমতি নিতে হবে। একই সঙ্গে পণ্যের মান নিয়ে তাদের ছাড়পত্রও থাকতে হবে। কিন্তু তিনি এ ধরনের কোনও প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় তার পণ্যগুলো কাস্টমস আইন অনুসারে ডিটেইশন করা হয়। যেখানে পরবর্তী সময়ে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। তবে আমার জানা মতে তিনি তা করেননি। ’
এদিকে ডা. ফেরদৌসের বন্ধুরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পর থেকেই তিনি সাহায্যসামগ্রী হিসেবে নানা পণ্য পাঠিয়েছেন। তনি নিয়ম মেনেই এসব উদ্যোগ নিয়েছেন বরাবরই। কিন্তু এবারই তিনি রাজনীতির শিকার হলেন বলে মনে করেন তারা।
কোয়ারেন্টিনের ১৪ দিন
বিষয়টি মানতে না পারলেও নিয়ম মানতে হয়েছে জানিয়ে চিকিৎসক ফেরদৌস বলেন, ‘আমাকে সরকার যা বলবে আমি তা করতে বাধ্য। কিন্তু পুরো ফ্লাইটে আমি একা এই নিয়মে পড়লাম কী করে? আবারও এসে কোয়ারেন্টিনে পড়তে হলে আমি আবারও আসবো। বন্দিত্বকালে সন্তানদের মুখ শক্তি জুগিয়েছিল উল্লেখ করে দেশত্যাগের আগে ডা. ফেরদৌস বলেন, ‘তৃতীয় দিনে প্রথম গোসল করি এবং পেট ভরে খেয়ে উঠে দাঁড়াই। মনকে বুঝাই যুদ্ধ কেবল শুরু। আমার পাশে মানুষ ছিল, এখনও আছে। দেশের ভালোবাসায় এতদূর এসেছি। আমার চোখে সন্তানদের চেহারা ভেসে উঠলো।’
যারা প্রশ্ন তুলেছেন তাদের পাল্টা প্রশ্ন করতে চান ফেরদৌসের বন্ধু সুভাস দে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গণমাধ্যমে দেখছি, ফেরদৌসের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। কারা দেয় এসব তথ্য? যারা এসব মন্তব্য করছেন তাদের দুরভিসন্ধিটা একটু আমাকে জানান।’
বের হয়ে সোজা প্লাজমা দিতে ছুট
কোয়ারেন্টিন সময় শেষে ফেরদৌস খন্দকার ছুটে যান প্লাজমা দিতে। তিনি সে সময় ফেসবুক লাইভে যুক্ত হয়ে বলেন, ‘আমি প্লাজমা ডোনেট করছি। কারণ, আমার অ্যান্টিবডি পজিটিভ আছে। একটি পরীক্ষিত চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছে প্লাজমা থেরাপি। বাংলাদেশে অনেকেই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। সেই তুলনায় প্লাজমাদাতা একেবারেই কম। আমি মনে করি, আপনাদের সবার একটি ভূমিকা আছে। এটি সিম্পল একটা জিনিস, শরীর থেকে রক্ত নিয়ে আলাদা একটি মেশিনে পরিশোধিত করে রক্তের কণিকাগুলো আপনাকেই ফেরত দেবে।
হতাশাগ্রস্ত চেহারা বন্ধুদের ক্ষুব্ধ করেছে
এই দু-তিন দিনের মধ্যে তিনি তার বন্ধু বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিভাগের চিকিৎসক সুভাষ দে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তার সঙ্গে যা করা হয়েছে, বাঙালি হিসেবে সেটি শোভন হয়নি। ফেরদৌস ক্ষতি করতে আসেনি। তার দ্বারা উপকারই হতো। নিজের টাকাপয়সা খরচ করে কিছু জিনিস নিয়ে এসেছিল সে। আসার আগেও করোনা হাসপাতালের অনেককে সাহায্য করছিল। আমার মনে হয়, এই উদাহরণ সামনে থাকলে সহযোগিতার জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না।’
তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন উল্লেখ করে সুভাষ দে বলেন, ‘আমি বুঝলাম না তার বিরেুদ্ধে আনা অভিযোগে এতো ভুল তথ্য এলো কীভাবে। বারবার ভুল তথ্য এলে যদি সেসবের সঙ্গে সত্যিই কেউ জড়িত থাকলে সেটা হালকা হয়ে যায়।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এত গোয়েন্দা সংস্থা। তারা কাদের কাছ থেকে তথ্য নেয়। আমার মেডিক্যালের কারও তথ্য নিতে আমার কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে। শুনে শুনে কারও নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তথ্য ব্যবহার ভালো কথা না।’ তিনি বলেন, ‘ফেরদৌস প্রতি তিন চার মাস পরপরই আসে। এলাকার হাসপাতালের কাজ করে। এখন কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হবে।’
যারা সঙ্গে ছিলেন
কোয়ারেন্টিন থেকে বের হয়ে যারা তার হয়ে লড়েছেন সেইসব বন্ধুদের সঙ্গে ছবি ফেসবুকে দেন। তার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না, দেশের সেবা করতেই তিনি ফিরে ফিরে আসেন দেশে সেই কথা বলেছেন যে বন্ধুরা, তাদের উদ্দেশে ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘গত দুই সপ্তাহে আমাকে নিয়ে তৈরি অনভিপ্রেত ঘটনাপ্রবাহে আমরা আবারও আত্মার টানে এক হয়ে গেলাম। কীভাবে ঝাপিয়ে পড়লি আমার পাশে। বাজি ধরলি যে, আমাদের এই ফেরদৌস, সেই ফেরদৌসই আছে। কিছুটা ঝুঁকিও নিলি অনেকে; না জেনে। তোদের ধারণাই সত্যি হলো। আমি সেই আগের ফেরদৌসই আছি। ঠিক যেমনটা ২০ বছর আগে ছিলাম। আদর্শ থেকে এক চুলও দূরে সরিনি। যে বিশ্বাসে আমরা একসঙ্গে চলেছি ক্যাম্পাসের সাতটি বছর।’
বারবার দেশেই ফিরবেন তিনি
সেই মুহূর্ত তাড়া করে বেড়িয়েছে ডা. ফেরদৌসকে যখন কিনা এয়ারপোর্টে নামামাত্র তাকে বলা হলো, ‘পাসপোর্টটা দিন, ফলো মি।’ তারপরও হেরে যাওয়ার পাত্র নন তিনি। বন্ধু সুভাষ দে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খুবই অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা। ও খুব কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু যেকোনও সুযোগ হলে সে আবারও সেবা করতে দেশে ফিরতে চাইবে। উপায় একটা ঠিকই বের করে নেবে।’
সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন