তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: কোন একসময় শুধু মায়ের ভাষাই জানতেন তারা। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানা ছিল না, ব্যবহারও করতেন না। কিন্তু মায়ের ভাষায় তো লেখাপড়ার সুযোগ নেই। পাশাপাশি জীবন-জীবিকার তাগিদ। ফলে চায়ের রাজধানী মৌলভীবাজারে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের লেখাপড়া বাংলা মাধ্যমেই করতে হয়। এতে কমছে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষার চর্চা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তারা নিজেদের মায়ের ভাষাই ভুলে যাচ্ছে।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, বড়লেখাসহ ৭ উপজেলায় ৯২টি চা বাগানের সদস্যরা দারিদ্র্য, সচেতনতার অভাব, সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, ভাষার পার্থক্যসহ বিভিন্ন সমস্যায় বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করেন। এ কারণে এ প্রজন্মের অনেকেই নিজেদের ভাষা ও কৃষ্টি ভুলে যাচ্ছে। চা শ্রমিকের সন্তান হিসেবে তাদের পরিচয়ে নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ঐতিহ্য যেন চা গাছের শিকড়ের মতোই শক্ত হয়ে আছে বাগানের লাইনের গন্ডিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের নিজস্ব আলাদা আলাদা বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, ধর্মীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি, প্রথা, ইতিহাস ও উৎসব বাঙালিদের মুগ্ধ করলেও চর্চা এবং সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা।
বিভিন্ন তথ্য সূত্রের বরাতে জানা গেছে, চা বাগানে মুন্ডা, সাঁওতাল, গুঁড়াও, মাহালি, সবর, পাসি, রবিদাস, হাজরা, নায়েক, বাউরি, তেলেগু, তাঁতি, কৈরী, দেশওয়ারা, বর্মা, কানু, পানিকা, কুর্মী, চাষা, অলমিক, মোদি, তেলি, পাত্র, মাঝি, রাজবংশী, মোদক, বাড়াইক, ভূমিজসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার মানুষ বসবাস করেন। তাদের অধিকাংশই পাহাড় টিলার পাদদেশে, বনজঙ্গলে কিংবা সমতল ভূমিতে প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবনযাপন করছেন। চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত এসব নৃ-গোষ্ঠীর জাতীয় অর্থনীতিতে আছে যথেষ্ট অবদান। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি অধিকারসহ মাতৃভাষা রক্ষার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছে এ জনগোষ্ঠী।
ভাষার চর্চা বাড়াতে সরকারি সুযোগ-সুবিধার উদ্যোগ নেওয়া হলে চা শ্রমিকদের মাতৃভাষা, তাদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা সহজ হবে, এমনটাই মনে করেন সুশীল সমাজের নাগরিক।
চা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেন এস এম শুভ। তিনি জানান, চা শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক মাতৃভাষা চর্চাকেন্দ্র না থাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মাতৃভাষার অধিকার হারাচ্ছেন। তাই চা বাগানের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষার জন্য বিভিন্ন চা বাগানের ভাষা-সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষ্যে সরকারি পৃষ্টপোষকতার প্রয়োজন।
তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমন কৈরী বলেন, ইসকুলে বাংলা ভাষায় কথা যেমন বলি, বাড়িতেও বাংলা ভাষায় কথা কই।
অভিভাবক কালী প্রশান্ত বলেন, চা বাগানে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সহাবস্থানের কারণে চা শ্রমিক হিসেবে তাদের পরিচয় তৈরি হয়েছে। যার কারণে এক একটা জানগোষ্ঠী আলাদা ভাষা গুলো চর্চার অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
দেওড়াছড়া চা বাগান বাসিন্দা পঁচাত্তরোর্ধ্ব নিমাই মুন্ডা বলেন, আমরা যারা বৃদ্ধ তাদের কয়েকজন নিজেদের ভাষা জানি। পরিবারে থাকলে ছেলে-মেয়েরা মুন্ডা ভাষায় দু’একটি কথা বলে। কিন্তু বাইরে বের হলে নিজেদের ভাষার চর্চা হয় না।
এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, চা বাগানের মানুষ অতি দরিদ্র। তাদের সন্তানরা এই বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করছে। তাদের অনেকই মাতৃভাষা সঠিকভাবে বলতে পারে না।
ভাষা রক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মুখ্য উপদেষ্টা রামভজন কৈরী বলেন, চা বাগানে একাধিক ভাষা আছে, যা হুমকির মধ্যে রয়েছে। সেই ভাষাসমূহ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এই ভাষাগুলির পরিচর্চা, শিশুদের নিজস্ব মাতৃভাষায় স্কুলে পাঠদানের ব্যবস্থা করা জরুরি।
লেখক ও শিক্ষক জাহাঙ্গীর জয়েস বলেন, আমাদের পূর্বসূরিরা মায়ের ভাষার জন্যে আন্দোলন করেছেন। জীবন দিয়েছেন। সেই শহীদ দিবস এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিভিন্ন দেশেও পালন হচ্ছে। অন্যদিকে, এখানে বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা অবহেলিত, সংকটে যা দুঃখজনক। প্রত্যেকের মাতৃভাষা চর্চার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বাস্তবায়নে আমাদের আরও আন্তরিকতার প্রয়োজন।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন জানান, চা বাগানের শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পাশাপাশি ভাষা রক্ষার জন্য সব রকমের সহযোগিতা করা হবে।
এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষা অফিসার ফজলুর রহমান বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাপ্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার লিখিত বর্ণলিপি নেই, সেই সব ভাষার লিপি তৈরি করা প্রয়োজন। যাদের ভাষার লিপি আছে তা সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।