তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: হাওরের বাতাসে হেলেদুলে নাচছে হুরহুরে ফুল। দুপুরটা গ্রীষ্মেরই। তবে মোটেই উজ্জ্বল আর তপ্ত নয়। লাজুক মুখের মতো মেঘের ঘোমটা থেকে রোদ এক পলক উঁকি দিচ্ছে, আবার লুকিয়ে যাচ্ছে। মৌলভীবাজারের রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়ক ধরে যাওয়ার পথে এই দৃশ্য। পথ গেছে কাউয়াদীঘি হাওরের বুক ছুঁয়ে, কুশিয়ারা নদীর কাছে। মেঘ এসেছে মেঘের সময়ে, বৈশাখেই। টুপটাপ দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও ঝরছে।
ভারী বৃষ্টি নামেনি বলে হাওর এখনো শুকনো। হাওরে খেত থেকে বেশির ভাগ ধান কেটে নেওয়া হয়েছে। অগ্রহায়ণ-পৌষের নাড়া আদিগন্ত ধূসর করে রেখেছে। কিছু খেতে পাকা ধান এখনো আছে। বিচ্ছিন্নভাবে কাটা চলছে। কাটা ধানের আঁটি নিয়ে কেউ খোলায় ফিরছেন, কেউ বাড়ি।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের আবহাওয়াই যেন চারপাশে, ‘হাওরের পানি নাইরে হেথায়, নাইরে তাজা মাছ/ বিলের বুকে ডালা মেলা, নাই রে হিজল গাছ।’
একটা সময় হাওরের যেদিকে চোখ গেছে অথই পানি। জেলেদের জালে ধরা পড়েছে রুপালি মাছ। পানিতে কোমর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে হিজলগাছ। এ রকম কোনো পরম মুহূর্তেই জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে’। হাওরে এখনো পানির ঢেউ আসেনি। হিজলের বন নেই। তবু হিজল আর ঘুঘু তো আছেই।
রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়কের পাশ ধরে হাওরপারের এই পথে কোনো মানুষের হাতের স্পর্শ ছাড়াই বসেছে রূপের পসরা। পথটির দুই পাশে কোথাও খোলা জায়গায়, কোথাও বাড়ির সীমানা ঘেঁষে কত রকমের যে ফুল ফুটেছে। কোনোটা চেনা, কোনোটা অচেনা। কোনো ফুলগুলো গ্রীষ্মের, কোনোটা বর্ষারও। সড়কের দীর্ঘ পথে এখানে-ওখানে মূর্তার বেতঝাড়ে ফুলের ইয়ত্তা নেই। যেন সাদা সাদা প্রজাপতি হাওয়ায় পালক মেলেছে।
সড়কের পাশে কোথাও ফুটে আছে বরুণ ফুল। এই ফুলের আরও নানা নামে পরিচয়। শ্বেতপুষ্প, কুমারক, সাধুবৃক্ষ, শ্বেতদ্রুম, বৈন্যা। স্থানভেদে হয়তো আছে আরও কোনো নাম।
বসন্তের মাঝামাঝি সময় থেকে বরুণ গাছে ফুল আসতে থাকে। ফুলে ফুলে গাছ ভরে যায়। মাসজুড়ে ফুলের বন্যা। উচ্ছ্বাসে ভাসতে থাকে গাছ। গাছটির পছন্দের আবাস আর প্রিয় ভূমি হচ্ছে হাওর-বাঁওড়, নদ-নদীর পাড়। বুকসমান পানিতেও এরা দিব্যি মানানসই, বেঁচে থাকতে পারে। কিছু গাছে ফুল ঝরে গেছে। এসেছে কতবেলের মতো গোলাকার ফল।
সড়কের পাশে সংখ্যায় কম হলেও চোখে পড়ল বেশ কিছু হিজলগাছ। জলজ কাদা-পানিতেই জন্মেছে। এদের প্রাণশক্তি প্রবল। বন্যার পানি আর তীব্র খরাতেও টিকে থাকে। কয়েক মাস পানির নিচে ডুবে থাকলেও নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে। তারা তো হাওরের জল-হাওয়াতে আছে। গাছ থেকে ফুল ঝরে পড়েছে। ঝালরের মতো ঝুলে আছে ফুলের লতাগুলো। রাতের অপেক্ষায় আছে কুঁড়ি। হিজলের ফুল গভীর রাতে ফোটে। সকাল হলে ঝরে যায়।
হালকা গোলাপি রঙের এই ফুলের সৌন্দর্যের তুলনা অপ্রতুল। সকালে মাটিতে ঝরে থাকা ফুল লাল রঙের গালিচা তৈরি করে রাখে যেন। ফুলে আছে একধরনের মিষ্টি গন্ধ। দুপুর গড়িয়ে গেছে, কিন্তু সেই গন্ধ গাছের শরীরে জড়িয়ে ছিল। হিজলের ফুল ফোটে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে।
সংখ্যায় কম হলেও চোঁখে পড়ল বেশ কিছু হিজলগাছ।
সড়কের ঢালুতে এখানে-ওখানে ফুটেছে হুরহুরে ফুল। সাদা আর ম্যাজেন্টা রঙের মিশ্রণে ফুলটি বড্ড চোখকাড়া। বাতাসে হেলেদুলে নাচছে। বাতাস থামলে তারাও চুপচাপ। তাতে রূপ উপচে পড়ছে আরও। কত কাল ধরে যে আপন খেয়ালে হাওরপারে তারা আছে।
বেগুনি রঙের বন্যা নিয়ে এসেছে জারুল ফুলও। টুকরো দ্বীপের মতো একেকটি বাড়ির সীমানায় গাছপালার ভিড়ে জারুলের এখন বাঁধনহারা হাসির সময়। একসময় হাওরপারেও প্রচুর জারুলগাছ ছিল। এখন কমে গেছে অনেক, তবে হারিয়ে যায়নি।
সড়কের দুই পাশের ডোবায় অযত্ন-অবহেলার মধ্যেও সাদা-হালকা বেগুনি রঙের কচুরিপানার ফুল বন্যার মতো ভাসছে। কোমল রূপে চোখ জুড়িয়ে রায়।
নাম না-জানা আরও কত যে ফুল এই হাওরের পথে!
সন্ধ্যার মেঘমালা থেকে আসতে শুরু করেছে আকাশের এক কোনে কনে দেখা আলো। কাজ থেকে বাড়ি ফিরছে মানুষ। হাওরপারের ফুলগুলোর হাসি জুড়িয়ে দিচ্ছে সবার ক্লান্ত মন। ফুড়ফুড়ে হয়ে মানুষের চোখের চাড়নিতে।