তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: বৃহত্তর সিলেটের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম মণিপুরি সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব মহারাসলীলা আগামী (মঙ্গলবার) ৮ নভেম্বর মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তুমুল হৈ চৈ, আনন্দ-উৎসাহে ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খ ধ্বনির মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের অবতার পুরুষ ভগবার শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখি রাধারলীলাকে ঘিরে এ দিনটি পালিত হবে।
কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে মণিপুরি অধ্যুষিত গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় এখন রাস উৎসবের রং ফুটছে। মন্ডপে মন্ডপে চলছে রং করানোর কাজ। এলাকার হাওয়ায় এখন নীরব সুর বাজছে। রাস আসছে, রাস আসছে। এই দিন দুপুরে উৎসবস্থল মাধবপুরের শিববাজার উন্মুক্ত মঠ প্রাঙ্গণে হবে গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য।
রাতে জোড় মন্ডপে রাসের মূল প্রাণ মহারাসলীলা। তাই মণিপুরি পল্লীর বাড়ির উঠোনে ছেলেমেয়েরা নাচছে। নাচের প্রশিক্ষণ চলছে। প্রশিক্ষক দেখিয়ে দিচ্ছেন নাচের ভঙ্গিসমূহ। কোনো জায়গায় চলছে রাসনৃত্যের মহড়া। কোনো জায়গায় রাখালনৃত্যের। এগুলো এখন শেষ সময়ের প্রস্তুতি। নৃত্যকে নিখুঁত করার ঘষামাজার শেষ পর্যায়।
আলাপ করে জানা যায়, এবছর মাধবপুর জোড় মন্ডপে ১৮০ তম রাস উৎসব পালিত হবে। মাধবপুরের রাসমেলার আয়োজক হচ্ছে মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘ। মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়। উৎসবস্থল মাধবপুরের শিববাজার উন্মুক্ত মঠ প্রাঙ্গণে হবে গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য। রাতে জোড় মন্ডপে রাসের মূল প্রাণ মহারাসলীলা।
অন্যদিকে কমলগঞ্জের আদমপুরে মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায় আয়োজন করছে পৃথক রাসমেলার। এবার তাদের পক্ষ থেকে হবে ৪০তম রাস উৎসব।
রাসোৎসবে মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার লোকজন মেতে উঠেন একদিনের আনন্দ উৎসবে। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশি-বিদেশি পর্যটক, বরেণ্য জ্ঞানী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে মাধবপুর ও আদমপুরের মন্ডপ প্রাঙ্গণ। রাসোৎসবকে ঘিরে মাধবপুর ও আদমপুরের মন্ডপগুলো সাজানো হয়েছে সাদা কাগজের নকশার নিপুণ কারুকাজে। করা হয়েছে আলোকসজ্জাও।
কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস আগে থেকেই চলে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। রাসোৎসবকে সফল করতে প্রায় মাসখানেক ধরে কয়েকটি বাড়িতে রাসনৃত্য এবং রাখালনৃত্যের প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলে। মাধবপুরে তিনটি জোড় মন্ডপের আওতায় এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাসলীলা দুই ভাগে বিভক্ত, গোষ্ঠলীলা ও রাসলীলা। গোষ্ঠলীলায় কৃষ্ণের বাল্যকালে মাঠে মাঠে বাঁশি বাজিয়ে ধেনু চড়াবার মুহূর্তগুলো অনুকরণ করা হয়। গোষ্ঠলীলাকে ‘রাখালনৃত্য’ বা ‘রাখোয়াল’ বলা হয়ে থাকে। রাসলীলায় অভিনীত হয় ‘গোপীনৃত্য’।
আয়োজকরা জানিয়েছেন, রাস উৎসবকে সফল করতে প্রায় মাসখানেক ধরে বিভিন্ন বাড়িতে রাসনৃত্য এবং রাখাল নৃত্যের প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলছে। মাধবপুরে তিনটি জোড় মন্ডপের আওতায় এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একেকটি মন্ডপে আছেন একজন পুরোহিত। সেই পুরোহিতের পরামর্শে একজন প্রশিক্ষক ধর্মীয় বিধিবিধান মতো গোপী বা শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেন।
প্রশিক্ষক’কে সহযোগিতা করতে একজন সহকারী প্রশিক্ষক আছেন। প্রশিক্ষক শিল্পীদের ঠিক করেন। এরপর সামাজিক বিধান মতো শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণের বাইরেও কেউ চাইলে রাসনৃত্যে অংশ নিতে পারেন। গোপীবেশী এই শিল্পীদের বয়স ১৬-২২ বছর। শুধু রাধার বয়স ৫-৬ বছর।
মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারন সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, এবারে মাধবপুর জোড়া মন্ডপে ১৮০তম মহারাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে, এম, খালিদ এমপি। সকাল ১১টা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে চলবে পরদিন ব্রাহ্মমুহুর্ত পর্যন্ত। ইতোমধ্যেই রাসোৎসব আনন্দময় করতে সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
এছাড়া একইদিন উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মহারাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে।