তিমির বনিক,মৌলভীবাজার থেকে: ৫২ ভাষা আন্দোলনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে যে ক’জন প্রতিবাদী নারী সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হচ্ছেন ছালেহা বেগম। সেই সময়টায় ময়মনসিংহ শহরের মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়তেন তিনি।
মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে স্কুল থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন ছালেহা। গৌরবোজ্জ্বল আন্দোলনের ৭০ বছর পূর্ণ হলেও সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়নি আজও। সেই আক্ষেপ ঘুচাতে মায়ের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের কাছে ভাষাসৈনিকের সন্তানরা আবেদন করলেও সুরাহা হচ্ছে না বিষয়টির।
২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে করা মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে শহিদ হন অনেকে। সর্বত্র শুরু হয় বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ময়মনসিংহেও। ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষার্থীরা সেদিন ক্লাসে যোগ দেয়নি। তারা বিদ্যালয়ে উঠিয়ে দেয় কালো পতাকা। শহরজুড়ে শুরু হয় মিছিল। সেই মিছিলের মূল কারিগর ছিলেন এই ছালেহা বেগম।
১৯৩৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জন্ম ছালেহা বেগমের। তাদের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার উছলাপাড়া গ্রামে। বাবা এএম আশরাফ আলী ছিলেন সাব রেজিস্ট্রার। তৎকালীন সময়ে পোস্টিং ছিলো পিরোজপুরে। মা মনিরুন্নেসা ছিলেন গৃহিনী। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে ছালেহা বেগম ছিলেন তৃতীয়। বড় বোন রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনে নারীদের নেতৃত্ব দেন।
ছালেহার মামা সি.এ মান্না ছিলেন বন বিভাগের কর্মকর্তা। সেই সুবাদে ময়মনসিংহের মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। থাকতেন স্কুলের হোস্টেলে।
ছালেহা বেগম নেতৃত্ব দিয়ে স্কুলে শোকের কালো পতাকা ওড়ানো শিক্ষকদের চোখে ছিল রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ। স্কুলের অধ্যক্ষ ও তৎকালীন জেলা প্রশাসক ছালেহা বেগমকে স্কুলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি ছালেহাকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এতে তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। অল্প বয়সেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। পরবর্তী জীবনে ছালেহা বেগম একেবারেই নিভৃতচারী হয়ে পড়েন। এমনকি নিজের এই গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কথাও পরিবারের সদস্যদের বাইরে প্রকাশ করতেন না কোথাও। ২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় নিজ বাড়িতে মৃত্যু বরণ করেন ছালেহা বেগম। সমাহিত করা হয় কিশোরগঞ্জ হয়বতনগর জমিদার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে।
ছালেহা বেগমের মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা মায়ের ভাষা সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি স্কুলের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য চেষ্টা শুরু করেছেন। গত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করেন ছালেহা বেগমের মেয়ে অ্যাডভোকেট সৈয়দা ফেরদৌস আরা। রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে স্কুলে কালো পতাকা টানানো ও ছাত্রীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেবার কারণে তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার ও মরণোত্তর পূর্ণ ভাষা সৈনিকের মর্যাদা দেবার দাবি জানিয়ে আবেদনটি করা হয়।
আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই বছরের ১ অক্টোবর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ছালেহা বেগমের স্কুল থেকে বহিষ্কারাদেশ বাতিলের বিষয়টি আইনানুগ নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি কোনো অগ্রগতি নেই সেই চিঠির। এর মধ্যে ছালেহা বেগমের আরেক মেয়ে অ্যাডভোকেট সৈয়দা ফরিদা আক্তার মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে পূণরায় আবেদন করেন।
ছালেহা বেগমের ছেলে সৈয়দ শাকিল আহাদ বলেন, আমার মায়ের বহিষ্কারাদেশ বাতিল ও একজন নারী ভাষা সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতির দাবি নিয়ে তারা জোর প্রচেষ্টা শুরু করলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ এটি নিয়ে টালবাহানায় গড়িমসি করছে। আমার মা নিজের স্বীকৃতি না চাইলেও আমরা মায়ের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি চাই। স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র তাদের কাছে নেই বলে জানিয়ে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রত্ব থেকে বহিষ্কার করা হয়। ৬১ বছর পর ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহিস্কারাদেশ বাতিল করে। আমার মা ছালেহা বেগমকে ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুল থেকে যে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছিল, সেটিও বাতিল করা হোক।
এ ব্যাপারে ময়মনসিংহের মুসলিম গার্লস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, বিষয়টি জানার পর ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছি কিন্তু ছালেহা বেগমের বহিষ্কারের বিষয়ে তথ্য পাননি। তার পরিবার বিভিন্ন বইয়ের লেখা উপস্থাপন করেছেন কিন্তু বইয়ে এমন তথ্য থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। তার পরিবার যদি কোনো প্রমাণপত্র দিতে পারে তবে আমাদের জন্য কাজটি সহজ হয়। এ কাজটি করতে পারলে তো সেটি আমাদের জন্যই সুনাম এবং গর্বের বিষয় হবে।