মো. রাসেল ইসলাম,যশোর জেলা প্রতিনিধি: সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে থাকায় আপাতত লকডাউন হচ্ছে না যশোর। তবে সংক্রমণ অনিয়ন্ত্রিত হলে লকডাউনের মতন কঠোর পদক্ষেপের ঈঙ্গিত দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সেই সাথে চলমান বিধিনিষেধ কার্যকরে আরো দৃঢ় অবস্থানে থাকারও ঘোষণা দিয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রেস ব্রিফিং করে সাংবাদিকদের কাছে এসব পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি যশোরের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি ও এটির বিস্তার রোধে চলমান কার্যক্রম সর্ম্পকেও বলা হয়। যশোর জেলা করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ কমিটি এই প্রেস ব্রিফিং করে। প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, বেনাপোল বর্ডার হয়ে বাংলাদেশে আসা ব্যক্তিদের যাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে করোনা টেস্টে তাদের মধ্যে পজিটিভের হার অনেক কম। যেটি অনেকটাই নগণ্য; শতকরা মাত্র ২ ভাগ বা এর আশেপাশে। এছাড়া গত দুই মাসেও জেলায় গড় করোনা পজিটিভের হারও নিম্নগামী ছিল। এরমধ্যে এপ্রিল মাসে এর গড় হার ছিল শতকরা ২৫ শতাংশ। গত মে মাসে সেটি ১৮ শতাংশে নেমে আসে। তবে চলতি জুনের গত তিন দিনে সংক্রমণের উর্ধ্বগতি থাকলেও সেটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। এরমধ্যে ১ জুন সংক্রমণের হার ছিল ২৮ থেকে ২৯ শতাংশ। এরপর দুই তারিখে ছিলো ২৩ শতাংশ। আর গতকাল র্যাপিড এন্টিজেন বাদে টেস্টে সংক্রমণ হার ছিলো ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ ২০২০ সালে প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন সংক্রমিতও হয়েছে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে সংক্রমণে হারের এসব তথ্য তুলে ধরেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবু শাহীন। তিনি বলেন, এটি সীমান্তবর্তী জেলা। পাশাপাশি এখানে একটি বিমান বন্দর রয়েছে। যার কারণে যশোর দিয়ে অন্যান্য আরো অনেক জেলার মানুষ যাতায়াত করেন। তাই যেকোন ধরণের সংক্রমণ এ জেলায় হতে পারে। তারপরও সংক্রমণের হার এখানে অনেক কম। আর এখানকার বর্তমান করোনা পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে এমনটা বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ভারতফেরত কোয়ারেন্টিন শেষ করা যাত্রীদের মধ্যে সংক্রমণের হার খুবই নগণ্য। বৃহস্পতিবার ১০০ জনের পরীক্ষা করে দুইজনের পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে। প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রশাসনে পক্ষ থেকে বলা হয়, বেনাপোল দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর হওয়ায় যশোর লকডাউন হলে আশপাশের আরো অনেক জেলার উপর তার প্রভাব পড়বে। এছাড়া সংক্রমণ এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যাওয়ায় লডডাউনেরও মতন পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়নি। যার জন্য সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ার পরও আপাতত যশোর লকডাউন হচ্ছে না। তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি সার্বক্ষনিক প্রশাসনের নজরদারির মধ্যে থাকছে। সংক্রমণ বাড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে যাওয়া হবে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান জানান, লকডাউন নয়; বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা নিশ্চিত করা ও করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। জেলায় করোনা সংক্রমণ একটু বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিক; কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। যশোরে করোনা প্রতিরোধ কমিটি এটি মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত আলোচনা হচ্ছে। এছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণে যেসব স্বাস্থ্যবিধি আরোপিত আছে, সেগুলো কার্যকরে আরও কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে।
যশোরের পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার বলেন, ভারতে করোনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানে মারাত্মক ধরন দেখা হয়। এর ফলে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সীমান্তে যাত্রীদের আগমন ও বহির্গমন বন্ধ করে দেয়। এতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক আটকা পড়েন ভারতে। দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও কলকাতায় উপ হাই-কমিশন থেকে বিশেষ অনুমতিক্রমে আটকে পড়া যাত্রীদের দেশে ফেরার জন্য যশোর জেলার বেনাপোল স্থলবন্দর উন্মুক্ত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৬ এপ্রিল ছয়জন বাংলাদেশি যাত্রী বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে জেলা প্রশাসন তাদের গ্রহণ করে।
আর এরপর শুরু হয় যশোর জেলায় ভারত থেকে আসা পাসপোর্টধারী যাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন; যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ২ জুন পর্যন্ত বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে চার হাজার ৩৭১ জন প্রবেশ করেছে। ভারতফেরত যাত্রীদের কোয়ারেন্টিনে জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে বেনাপোল এলাকায় ১৩টি হোটেল, ঝিকরগাছা উপজেলার গাজীর দরগাহ মাদরাসা হোস্টেল এবং যশোর শহরের ১৯টি হোটেল নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও শেখ হাসিনা আইটি পার্ক, এফপিএবির হোস্টেলসহ মোট ২০টি স্থানে কোয়ারেন্টিনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। প্রত্যেক হোটেলে জেলায় কর্মরত সরকারি অফিসারদের মধ্য হতে ট্যাগ অফিসার ও চিকিৎসককে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই যাত্রীর চাপে এসব হোটেলসমূহ পূর্ণ হয়ে গেলে তাদের অন্য জেলায় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খুলনা, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, মাগুরা, কুষ্টিয়া ও বাগেরহাটে এ পর্যন্ত এসব জেলায় এক হাজার ৬১৮ জনকে পাঠানো হয়েছে। এই সময়ে ২৯টি লাশ গ্রহণ করে অ্যাম্বুলেন্সে তাদের নিজেদের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।
২৬ এপ্রিলের মোট ১৩ জন সার্টিফাইড কোভিড রোগী গ্রহণ করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভারতফেরত যাত্রীরা কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আগ্রহী ছিলেন না। তারা আর্থিক ও মানসিভাবে মোটেও রাজি হচ্ছিলেন না। সেক্ষেত্রে হোটেলগুলোতে কথা বলে অল্প টাকায় তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের জন্যে উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সামর্থ্য অনুযায়ী থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরপরেও অনেক অসহায় ব্যক্তির বিল জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া হয়েছে। অন্য জেলাগুলোতে ভারতফেরত যাত্রীদের নিয়ে লোকজনের প্রতিক্রিয়া থাকলেও যশোর ছিল পুরোপুরি ব্যতিক্রম। অনেকে স্বেচ্ছায় এসব যাত্রীকে বিনামূল্যে খাবার দিয়ে যাচ্ছেন। বিগত ঈদুল ফিতরের দিনে যশোর সদরে জেলা প্রশাসন, বেনাপোলের হোটেলে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মেয়র উন্নতমানের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। পরিবারের সাথে কোন পুরুষ যাত্রী না থাকা নারী যাত্রীদের জন্য ডেডিকেটেড কোয়ারেন্টিন সেন্টার নির্ধারণ করা হয়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এই প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক হুসাইন শওকত, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, প্রেস ক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন প্রমুখ।