অনলাইন ডেস্কঃ দেশে করোনাভাইরাস উপসর্গ ধরা পড়ার পরে শুধুমাত্র একমাসে মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভসসহ সংশ্লিষ্ট প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ টন। শুধু ঢাকায় উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার ৭৬ টন। যার বড় একটি অংশ যত্রতত্র ফেলার কারণে মাটি ও পানিতে মিশছে। এতে মাটি ও পানিতে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যার কারণে ভয়াবহভাবে গণসংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি করোনার সময়ের প্লাস্টিক বর্জ্য পরিস্থিতি নিয়ে করা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)’র গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণা থেকে সংগঠনটি জানায়, গত ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১ মাসে সারা দেশে পলিথিন ব্যাগের বর্জ্য ৫ হাজার ৭৯৬ টন, পলিথিন হ্যান্ডগ্লাভস সহ ৩ হাজার ৩৯ টন, সার্জিক্যাল হ্যান্ডগ্লাভস ২ হাজার ৮৩৮ টন, সার্জিক্যাল মাস্ক ১ হাজার ৫৯২ টন ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল থেকে ৯০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে। রাজধানীর পরিসংখ্যানে জানানো হয়, এ সময়ে শুধু ঢাকায়ই সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩১৪ টন সার্জিক্যাল হ্যান্ডগ্লাভসের বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে। এ ছাড়া, পলিথিন হ্যান্ডগ্লাভস ৬০২ টন, সার্জিক্যাল মাস্ক ৪৪৭ টন, পলিথিন ব্যাগ ৪৪৩ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল থেকে ২৭০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে।
এসডো’র ওই জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বেশি যে ধরনের একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে সেগুলো হলো- সার্জিকাল ফেসমাস্ক, সার্জিকাল ও পলিথিনের তৈরি পাতলা হ্যান্ডগ্লাভস এবং পলিথিনের বাজারের ব্যাগ। বাংলাদেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ জনসাধারণ এখন কোনো না কোনো ধরনের ফেস মাস্ক ব্যবহার করছে। পুরো দেশের ২৩ শতাংশ জনসাধারণ এখন একবার ব্যবহারযোগ্য সার্জিকাল ফেসমাস্ক ব্যবহার করে। এর ২০ শতাংশ শহরাঞ্চলে ও ৩ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে থাকেন। লকডাউনের এক মাসে সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৪৫ কোটি সার্জিকাল ফেসমাস্ক ব্যবহার করা হয়েছে, যা থেকে অন্তত ১৫ হাজার ৯২ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে। রাজধানী ঢাকাতে সার্জিকাল ফেসমাস্কেও ব্যবহার দেশের অন্যান্য শহরাঞ্চলের চেয়ে বেশি। ঢাকা শহরে বর্তমানে বসবাসকারীদের অন্তত ৩৫ শতাংশ নিয়মিত সার্জিকাল ফেসমাস্ক ব্যবহার করছেন। ঢাকার বাইরে অন্যান্য শহরাঞ্চলগুলোতে এই হার ২৮ শতাংশ। কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহর-গ্রাম উভয় এলাকাতেই একবার ব্যবহারযোগ্য হ্যান্ডগ্লাভস ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। দুই ধরনের হ্যান্ডগ্লাভস বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে- পলিথিনের তৈরি হ্যান্ডগ্লাভস ও সার্জিকাল হ্যান্ডগ্লাভস। দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে, যেমন- ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি শহরে সার্জিকাল হ্যান্ডগ্লাভসের ব্যবহার খুব বেশি। তবে অন্যান্য জেলাগুলোতে পলিথিনের তৈরি পাতলা হ্যান্ডগ্লাভস ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। বর্তমান জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়ির বাইরে বিভিন্ন কাজের সময় পলিথিনের তৈরি পাতলা হ্যান্ডগ্লাভস ব্যবহার করছে। এদের বেশিরভাগই, প্রায় ২৫ শতাংশ শহরাঞ্চলে বসবাস করে। শহরাঞ্চলে বসবাসকারী এবং রাস্তায় বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের মধ্যে পলিথিনের পাতলা হ্যান্ডগ্লাভস ব্যবহার বেশি। জরিপ অনুযায়ী শহরবাসী ও দোকনদাররাই পলিথিনের তৈরি পাতলা হ্যান্ডগ্লাভস ব্যবহারকারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক। শুধু তাদের ব্যবহারের পরে ফেলে দেয়া ১২১ কোটি ৬০ লাখ হ্যান্ডগ্লাভস থেকেই এক মাসে উৎপন্ন হওয়া প্রায় তিন হাজার ৩৯ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। এই বর্জ্যরে প্রায় ২০ শতাংশ শুধু রাজধানী শহরেই উৎপন্ন হয়েছে। সারা দেশে গড়ে ৯ শতাংশ জনসাধারণ অপেক্ষাকৃত ভারি সার্জিকাল হ্যান্ডগ্লাভস ব্যবহার করেছেন। তবে চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে পলিথিনের শপিং ব্যাগ বা বাজারের ব্যাগ থেকে। গত একমাসে পলিথিনের ব্যাগ থেকে উৎপন্ন হয়েছে ৫ হাজার ৭শ’ ৯৬ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য। সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে কেনা-বেচার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে অনেক গুন বেশি। বাসাবাড়ি ও বাজারে পলিথিনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে ত্রাণ বিতরণ এবং দোকানের তৈরি খাবার বাড়িতে সরবরাহের ক্ষেত্রে মোড়ক হিসেবেও। শুধু ঢাকাতেই বাসাবাড়ি ও কেনাকাটায় ব্যবহৃত পলিথিনের ব্যাগ এবং দুঃস্থদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে ব্যবহৃত পলিথিনের প্যাকেট থেকে প্রায় ৪৪৩ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো যেমন করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে মনে কর হচ্ছে, তেমনই প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এই সময়ে তারা বেশ বড় ভূমিকা রাখছে।
করোনা: প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে গণসংক্রমণের ঝুঁকি
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব প্লাস্টিক বর্জ্য সঠিক যথাযথভাবে নিষ্কাশন না করা হলে এগুলো থেকে মাটি, পানি ও বায়ুসহ পরিবেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহতে ভয়াবহ দূষণ দেখা দিবে। বিশেষ করে চিকিৎসাসেবা থেকে উৎপন্ন হওয়া হাসপাতাল বর্জ্যে ভেজা-শুকনো সব ধরনের দ্রব্য মিশে থাকে যা পৃথক করা যায় না, এবং এগুলো অত্যন্ত ছোঁয়াচেও হয়ে থাকে। যখন স্বল্প সময়ে অনেক বেশি পরিমাণ চিকিৎসাসেবা বর্জ্য উৎপন্ন হয় এবং তা অব্যাহত থাকে, তখন সেসব বর্জ্য ভাগাড়ে পাঠানো অথবা পুড়িয়ে ফেলার আগে যথোপযুক্ত ভাবে পৃথক করা সম্ভব হয় না। এসব বর্জ্যরে বেশিরভাগ অংশই আবার প্লাস্টিকের তৈরি হয়ে থাকে। এসব বর্জ্য সাধারণত: পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং সাধারণ বর্জ্যের পাশাপাশিই এগুলোও পুড়ানো হয়ে থাকে। বিপুল পরিমাণে এসব ছোঁয়াচে চিকিৎসা বর্জ্য পোড়ানোর ফলে বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়া, ধাতব বর্জ্য এবং ছোঁয়াচে বায়ুবাহিত উপাদান ও জীবাণু উৎপন্ন হয়, এবং আশেপাশের এলাকার বাতাসের মান বিপর্যস্ত হয়। এসব ছোঁয়াচে চিকিৎসা বর্জ্য যথাযথ ব্যবস্থাপনা ছাড়া সরাসরি ভাগাড়ে ফেললে ছোঁয়াচে উপাদান ও জীবাণু মাটি ও বৃষ্টির পানিতে মিশে এবং সবশেষে গিয়ে বিভিন্ন জলাধারে মিশে অথবা বিষাক্ত পানির ডোবায় পরিণত হয়। এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ গাছপালা শুষে নেয় এবং পরবর্তীতে এসব গাছপালা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী খাদ্য হিসেবে অথবা অন্য বিভিন্নভাবে ব্যবহার করার ফলে তাদের বিভিন্ন রোগ বা মৃত্যুও হতে পারে।
এসব বর্জ্যের ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব না দিলে জীবাণুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটতে পারে বলে জানিয়ে এসডো‘র মহাসচিব ড. শাহরিয়ার রহমান বলেন, উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে পরিবেশে। যা মাটি ও পানিতে মিশে চলে আসতে পারে মানুষের খাদ্যচক্রে। এতে জীবাণুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটতে পারে, যা রূপ দিতে পারে গণসংক্রমণের। তাই এসব বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় সরকারকে এখনি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষ সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে এসব ক্ষতিকর বর্জ্য ফেলছে, কখনো কখনো খোলা জায়গায়ও ফেলছে। এতে এসব বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মীরা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় অনেক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মী ইতোমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আতঙ্কে অনেকে চাকরি ছেড়েছেন বলে জানিয়ে, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে বলেও জানান তিনি। ক্ষতিকর এসব বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য দ্রুত একটি গাইডলাইন তৈরি এবং আক্রান্ত বাসা ও হাসপাতালের বর্জ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করতে নতুন পরিকল্পনা করারও পরামর্শ দেন তিনি।
পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (বায়ুমান) জিয়াউল হক বলেন, এ মুহূর্তে কোভিড-১৯ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের সংস্থাগুলো রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। নিয়মিত আলোচনা চলছে এবং এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে পরিবেশ অধিদফতর। যত্রতত্র এসব আবর্জনা না ফেলে জনগণকে সহযোগিতা করতে হবে। নইলে এটি আরো কঠিন হবে। ত্রাণ বিতরণে ব্যবহারের কারণে পলিথিন বর্জ্য বেড়েছে বলে জানিয়ে ত্রাণ কার্যক্রমে পলিথিন ব্যবহার না করতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
উৎসঃ দৈনিক ইত্তেফাক