শরীরের ভিতরের কলকব্জা বিগড়ে গেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের কাছে ছুটি। হরেক রকম পরীক্ষা, ওষুধ, ইঞ্জেকশন, মাপা খাওয়াদাওয়া চলতে থাকে ঘড়ি ধরে। উদ্দেশ্য একটাই, রোগ যেন বেশি দিন কাবু করে রাখতে না পারে। ত্বকের কিছু রোগের ক্ষেত্রে কিন্তু এমন সচেতনতা দেখা যায় না। খুব বাড়াবাড়ি না হলে অনেকেই চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। অথচ, উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে ত্বকের অসুখও যথেষ্ট সমস্যায় ফেলতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে, ফেলে রাখলে তা থেকে নানা অসুখও হতে পারে।
যেমন, সোরিয়াসিস। পরিচিত রোগ। প্রচুর মানুষ ত্বকের এই সমস্যায় ভোগেন। সবচেয়ে বড় কথা, এই রোগ ক্রনিক। অর্থাৎ এ রোগ থেকে একবারে রেহাই মেলে না। বার বার এ অসুখ ঘুরেফিরে আসে। কয়েক সপ্তাহ স্বমহিমায় থাকে, তার পর আবার কিছু দিনের জন্য চুপচাপ হয়ে যায়। পরে আবার দেখা দিতে পারে এই ধরনের সমস্যা। কিন্তু এমনটা কেন হয়? এ অসুখের চিকিৎসাই বা কী? এ বার একে একে জানব…
সোরিয়াসিস কী?
ত্বক বিশেষজ্ঞ ডা. সন্দীপন ধরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সোরিয়াসিস আসলে ত্বকের এক বিশেষ ধরনের ক্রনিক সমস্যা। আমাদের ত্বকের দু’টি প্রধান স্তর থাকে— বাইরের অংশটিকে বলা হয় এপিডার্মিস, এবং ভিতরের ত্বককে ডার্মিস। এপিডার্মিসের উপরের দিকে থাকে মৃত কোষ বা কেরাটিন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর এই মৃত কোষ ঝরে গিয়ে নীচে থাকা সজীব কোষগুলি উপরে উঠে আসে। আবার তা এক সময়ে
খসে পড়ে। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। কোনও অবস্থায় যদি এই প্রক্রিয়ায় গোলমাল ঘটে, তা হলেই সোরিয়াসিস দেখা দেয়।
ডা. সন্দীপন ধর বললেন, ‘‘সাধারণত ২৮ দিন অন্তর ত্বকের এই বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি অর্থাৎ ‘এপিডার্মিস টার্নওভার’ চলতে থাকে। কিন্তু কখনও কখনও তা কমে আসে। এমনকি ৩-৪ দিনের মাথাতেও এপিডার্মিস টার্নওভার হয়। এই অবস্থাই সোরিয়াসিস।’’
লক্ষণ কী?
সোরিয়াসিসের গোড়ার দিকে লালচে গুটির মতো প্যাচ দেখা যায়। ধীরে ধীরে ত্বকের এই অংশগুলি পুরু হয়ে ওঠে। কখনও আবার তা অত্যন্ত শুষ্ক হয়ে ফেটে যেতে থাকে, ছাল ওঠে, চুলকানি হয় বা জ্বালা করতে থাকে। সোরিয়াসিস মূলত বুক, পিঠ, কনুই, পায়ে দেখা যায়। তবে, মাথাতেও সোরিয়াসিস হয়। ডা. সন্দীপন ধর বললেন, ‘‘মাথায় অনেক সময়ে অত্যধিক খুশকি দেখা দিলে, সেটাও এই রোগেরই ফল হতে পারে। এতে চুল পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার, নেল সোরিয়াসিস নখে গর্ত তৈরি করে, নখের রং বদলে যায়। চিকিৎসা না করালে নখ উঠে আসতে পারে।’’ যদি ত্বকের অনেকটা জায়গা লাল হয়ে ফুলে যায় এবং তার সঙ্গে ব্যথা বা অস্বস্তির ভাব থাকে, তা হলে সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যত দ্রুত এই ক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরু হবে, ততই এ রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অভিজ্ঞ চিকিৎসক সাধারণত পারিবারিক ইতিহাস জেনে নিয়ে এবং উপসর্গগুলি দেখেই রোগ নির্ণয় করতে পারেন। তবে, কিছু ক্ষেত্রে স্কিন বায়পসিরও প্রয়োজন হয়।
শীতে ত্বক দ্রুত শুকিয়ে যায় বলে এই সমস্যা বাড়ে। নিয়মিত ত্বকের যত্ন প্রয়োজন। ত্বক পরিষ্কার তো রাখতেই হবে, সঙ্গে ইমোলিয়েন্ট জাতীয় লোশন ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন ডা. ধর। এতে ত্বকের প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা বজায় থাকবে, ত্বক নরমও থাকবে।
সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস ঠিকমতো চিকিৎসা না করিয়ে ফেলে রাখলে বা নিয়মিত ওষুধ না খেলে পরবর্তী কালে সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিসের সম্ভাবনা থাকে। এতেও সাধারণ আর্থ্রাইটিসের মতোই গাঁটে ব্যথা হয় এবং জয়েন্টগুলো ফুলে যায়। তবে এমনও দেখা গিয়েছে, শরীরে সোরিয়াসিসের অন্য লক্ষণগুলি অনুপস্থিত। অথচ, হাত এবং পায়ের আঙুল আক্রান্ত হয়েছে এই রোগে। সাধারণত সোরিয়াসিসের রোগীদের ক্ষেত্রে ১০-৩৫ শতাংশের মধ্যে সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিছু ক্ষেত্রে পাকাপাকি ভাবে জয়েন্টগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
রিস্ক ফ্যাক্টর কী কী?
সোরিয়াসিস কেন হয়, তার কারণ এখনও অস্পষ্ট। সাধারণত মনে করা হয়, কিছু জিনগত এবং পরিবেশগত কারণে এই রোগ হতে পারে। ডা. সন্দীপন ধরের কথায়, ‘‘কোনও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সোরিয়াসিস হয় না। তবে রোগটা শরীরে উপস্থিত থাকলে কিছু কিছু ওষুধ সেবন করলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। অত্যধিক স্ট্রেসজনিত কারণেও সোরিয়াসিস হয়। কারণ স্ট্রেসের ফলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক দুর্বল হয়ে যায়। অতিরিক্ত মদ্যপান, ধূমপান, স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া বা চড়া রোদও এই ক্ষেত্রে রিস্ক ফ্যাক্টর।’’ তাই এ সব যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে পারলেই ভাল।
কিছু জরুরি কথা
•সোরিয়াসিস কোনও ছোঁয়াচে অসুখ নয়। এটি মূলত জিনঘটিত রোগ। তাই রোগীর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার প্রয়োজন নেই।
•এই রোগে বেশি ক্ষারযুক্ত সাবান ব্যবহার করা একেবারেই উচিত নয়। গ্লিসারিনযুক্ত সাবান বা বেবি সোপ ব্যবহার করা যেতে পারে। ময়শ্চারাইজ়ার বা নারকেল তেলও এ রোগে বেশ উপকারী।
•পোশাক ফুলস্লিভ এবং সুতির হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ সিন্থেটিক জাতীয় পোশাক এই রোগ বৃদ্ধি করে।
•বিশেষ নজর রাখতে হবে খাওয়াদাওয়ার দিকেও। রোজ অন্তত দু’ধরনের মরসুমি ফল রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়। ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ ফল খেতে পারলে সবচেয়ে ভাল। প্রোটিনের পরিমাণও বাড়াতে হবে।
•সর্বোপরি, নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হবে। মনে রাখতে হবে, সোরিয়াসিস মোটামুটি সারা জীবনের সঙ্গী। তাই নিয়মিত ওষুধ খাওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো চলা এ ক্ষেত্রে খুব জরুরি। নিজের ইচ্ছেমতো দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাওয়া বা হঠাৎ চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া— দুই-ই সমান ক্ষতিকর।
এই রোগ একেবারে সেরে যায় না ঠিকই। কিন্তু নিয়মমতো চললে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকে সোরিয়াসিসের উপসর্গগুলো। জটিলতাও বাড়ে না। তাই রোগকে কাবু করতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।