ভিয়েতনাম ও কাতার থেকে ফেরত আসা ৮১ জন বাংলাদেশির বিরুদ্ধে মামলা ও তাদের জেল হাজতে পাঠানোর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে অভিবাসন খাতের ১৯টি সংগঠনের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টস (বিসিএসএম)। তারা এই ৮১ জনসহ দেশে ফেরার পর ভিত্তিহীন অভিযোগে আটক সব অভিবাসীর মুক্তির দাবি জানিয়ে বলেছে, বিনা অপরাধে স্বদেশে গ্রেফতারের এমন ঘটনা ভীষণ দুঃখজনক এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
বৃহস্পতিবার (৩ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যম পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে এই দাবি জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিদেশে যাওয়ার জন্য যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে তারা কাজের উদ্দেশ্যে ভিয়েতনামে গিয়েছিলেন। কিন্ত তারা সেখানে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত চাকরি ও ঠিকমতো বেতন পাননি। ধারাবাহিকভাবে নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর প্রতিকারের আশায় তারা বাংলাদেশ দূতাবাসে যান এবং নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগ দেন। মাসখানেকেরও বেশি সময় মানবেতর জীবন যাপনের পর দেশে ফিরে তাদের ঠাঁই হয় কোয়ারেন্টিন সেন্টারে। সেখান থেকে যখন তারা বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখছিলেন, তখন তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। গত ১ সেপ্টেম্বর এই ৭৯ জন ও দুইজন কাতার ফেরতসহ মোট ৮১ জনকে জেলে পাঠানো হয়েছে এবং গদবাধা সেই পুরনো অভিযোগ এনে বলা হয়েছে, ‘এরা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। ভবিষ্যতে তাদের বাংলাদেশে অপরাধে জড়ানোর সম্ভাবনা রহিয়াছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক।’
অভিবাসী কর্মীদের বিষয়ে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিস্ময়কর ব্যাপার হলো— এর আগে কুয়েত, কাতার ও বাহরাইন থেকে আসা ২১৯ জনকে দিয়াবাড়ি থেকে জেলে নেওয়ার সময় যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, এবারও সেই একই অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিটি শব্দ, বাক্য একই। তাদের ক্ষেত্রেও তখন বলা হয়েছিল, ‘দিয়াবাড়ির কোয়ারেন্টিন সেন্টারে থাকাকালে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত থাকার উদ্দেশ্যে তারা সলাপরামর্শ করতো। পুলিশ এসে জিজ্ঞাসা করলে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। ধর্তব্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে সন্দেহে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হলো।’ কোনও ধরনের তদন্ত না করেই যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় পুলিশের এজাহারে। সেখানে বলা হয়েছে, এই অভিবাসী কর্মীরা ভিয়েতনামের জেলে ছিলেন— যা পুরোপুরি মিথ্যাচার। বাস্তবতা হলো এই বাংলাদেশিরা নিজেরাই ভিয়েতনামের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে অভিযোগ করেছিলেন দালালদের বিরুদ্ধে।
বিবৃতিতে বলা হয়, গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও আটক ব্যক্তিদের পরিবার বলছে, এবছরের ৩ জুলাই ভিয়েতনামের বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় ১১ জন বাংলাদেশি ঢাকায় ফেরেন। এরপরেই জানা যায়, আরও অন্তত ২৭ বাংলাদেশি একই অভিযোগ নিয়ে দূতাবাসে গিয়েছেন। ক্রমেই সেই সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং একশ’ ছাড়িয়ে যায়। এই প্রবাসীরা দূতাবাসকে জানান, ভিয়েতনামে ভালো চাকরির মিথ্যা প্রলোভন ও উচ্চ বেতনের হাতছানি দেখিয়ে কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সি ও ট্রাভেল এজেন্সি একজোট হয়ে জনপ্রতি ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নেয়। এরপর বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে ২০১৯ সালের শেষ দিকে এবং ২০২০ সালের প্রথম কয়েক মাসের বিভিন্ন সময়ে তাদের ভিয়েতনাম পাঠায়। কিন্তু সেখানে তাদের ঠিকমতো কাজ দেওয়া হয়নি। বরং নানাভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচানোর তাগিদে ও দেশে ফেরার জন্য তারা দূতাবাসে হাজির হয়ে লিখিত অভিযোগ দেন।
‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩’ অনুযায়ী, বিদেশে কোনও সমস্যা হলে অভিবাসীরা নিজ দেশের দূতাবাসে যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। অথচ বলা হলো, এরা দূতাবাস দখল করতে গিয়েছে। অবশ্য গণমাধ্যমে বারবার খবর প্রচার এবং এসব অভিবাসীর অনড় অবস্থানের কারণে পরে তাদের দেশে আনতে রাজি হয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস। আমাদের প্রশ্ন হলো, প্রতারিত হয়ে দূতাবাসে যাওয়া কি অপরাধ? পাচারকারীদের শাস্তি চাওয়া অপরাধ? নাকি মিথ্যা মামলা বা ভুল তথ্য দিয়ে অভিযোগ বানানো অপরাধ?
ভিয়েতনামের ঘটনাটি নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে বলা হয়, আমরা ভিয়েতনামের এই ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে তদন্তের জোর দাবি জানাচ্ছি। দালাল, রিক্রুটিং এজেন্সিসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে অবিলম্বে তদন্তের আওতায় আনতে হবে। এই বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমরা প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আহ্বান জানাচ্ছি। এর আগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা ২১৯ জনকেও এভাবে জেল হাজতে পাঠানো হয় এবং এখনও পর্যন্ত তারা জামিন পাননি। অথচ তাদের কারও বিরুদ্ধেই বাংলাদেশে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি। বিদেশে তারা অতিরিক্ত সময় অবস্থান করা কিংবা টকটাইম বিক্রির মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সাজা খেঁটে দেশে ফিরেছিলেন। এমতাবস্থায়, আমরা বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টস (বিসিএসএম) এভাবে আটক সব অভিবাসীর অনতিবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের গ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধের আহবান জানাচ্ছি।
যৌথ বিবৃতি প্রদানকারী সংগঠনগুলো হলো— রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু), ওয়্যার্বি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ), বাংলাদেশি অভিবাসী মহিলা শ্রমিক এসোসিয়েশন (বমসা), হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস), বাসুগ, ইমা রিসার্চ ফাউন্ডেশন, ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব অল্টারনেটিভ ফিন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউশন (ইনাফি) বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কন্সট্রাকশন অ্যান্ড উড ওয়ার্কার্স ফেডারেশন (বিসিডব্লিউডব্লিউএফ), ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল একশন (ইপসা), বাংলাদেশ অভিবাসী অধিকার ফোরাম (বোয়াফ), বাস্তব, রাইটস যশোর, সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশন্স (ডেভকম) লি., ফিল্মস ফর পিস ফাউন্ডেশন এবং চেঞ্জ মেকার্স।