নারায়ণগঞ্জে গণধর্ষণ ও হত্যার দায় স্বীকার করে তিন আসামির জবানবন্দি দেয়ার দেড় মাস পর কথিত মৃত কিশোরী জীবিত উদ্ধারের ঘটনায় পৃথক দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা পুলিশ। তবে এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
বিশেষ করে আসামিদের ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে তিনজনের কাছ থেকে জবানবন্দি আদায়ের ঘটনাকে ‘জজ মিয়া নাটক’ বলে অভিহিত করছেন নগরবাসী।
এদিকে মামলার বাদীপক্ষ মামলা তুলে নেবেন বলে জানালেও সেটির আইনি প্রক্রিয়া বেশ জটিল বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি)।
আর আসামিপক্ষের আইনজীবী জানিয়েছেন, রাতারাতি হিরো হতে চাওয়ায় এ মিথ্যা ও লোমহর্ষক মিথ্যা জবানবন্দির নাটক সাজিয়েছিল পুলিশ।
জেলা পুলিশ সুপার বলছেন, ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যেই মামলার নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তাও নিয়োগ করা হয়েছে।
জানা গেছে, চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা এ মামলা, আসামিদের গ্রেফতার ও জবানবন্দির বিষয়সহ পুরো ঘটনার সঠিক রহস্য উদঘাটন করতে সোমবার রাতেই জেলা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলা ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। একই সঙ্গে পুলিশের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক জবানবন্দি আদায় ও আসামিদের পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশাসনকে প্রধান করে আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। পরে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আগামী তিন কার্য দিবসের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম পিপিএম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলছেন, আলোচিত এ ঘটনার বিষয়টি সুষ্ঠু সমাধানের জন্য সব ধরনের প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি আসামিরা যাতে ন্যায়বিচার পায় সে বিষয়টিও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
অপরদিকে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের ৫ আইনজীবীর পক্ষে অ্যাডভোকেট শিশির মনির হাইকোর্টে রিভিশন মামলা দায়ের করলে হাইকোর্ট জিসা মনি অপহরণ মামলার নথি তলব করেছেন।
ইতোমধ্যেই উদ্ধার হওয়া কিশোরী জিসা মনি পালিয়ে বিয়ে করার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সোমবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আফতাবুজ্জামানের আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে জিসা মনি। পাশাপাশি তার স্বামী ইকবালকে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ মঙ্গলবার দুপুরে আদলতে হাজির করে। আদালত আগামী ২৭ আগস্ট শুনানির তারিখ ধার্য করে তাকে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন।
এদিকে মঙ্গলবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে তথাকথিত গণধর্ষণ ও হত্যার শিকার স্কুলছাত্রী ফিরে আসার খবর প্রকাশ হলে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তখন আদালত আইনজীবী শিশির মনিরকে লিখিতভাবে আবেদন করতে বলেন। মঙ্গলবার এ সংবাদ বিষয়ে হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চে একটি রিভিশন মামলা দায়ের করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন আইনজীবীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির রিভিশনটি দায়ের করেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, রিভিশনে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় দায়েরকৃত মামলা এবং মামলাপরবর্তী প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা, বৈধতা এবং যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। উক্ত আবেদনে আদালতে ওই মামলার নথি তলব করে পরীক্ষাপূর্বক উপযুক্ত আদেশ প্রদানের প্রার্থনা করা হয়েছে। আবেদনটিতে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার, সদর থানার ওসি, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, বাদী এবং আসামিদের বিবাদী করা হয়েছে।
এদিকে মেয়ে জিসা মনিকে ফিরে পাওয়ার পর তার পরিবার মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন জিসা মনির বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন। কারাগারে আটক ৩ আসামি ও মিথ্যা ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দির ব্যাপারে তিনি বলেন, পুরো বিষয়টির সঠিক বিচার চাই আমরা।
তবে মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন বলছেন, আইনের ধারা অনুযায়ী সেটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। প্রয়োজনে আরও একটি মামলা হতে পারে এবং দুইটি মামলার তদন্ত চলমান থাকবে।
অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. রোকন উদ্দিন জানিয়েছেন, আমরা জানতে পেরেছি পুলিশ তাদের দোষ ধামাচাপা দিতে আসামিদের আরও একটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে এ মামলা চলমান রাখার প্রক্রিয়া করছে।
তিনি বলেন, সদর থানা পুলিশ বলছে- আসামিরা হয়তো অন্য এমন কোনো ঘটনায় জড়িত বলে জবানবন্দি দিয়েছে। পুলিশের এমন বক্তব্য শুধু হাস্যকরই নয়, রীতিমতো ভয়ঙ্কর এই মিথ্যাকে ঢাকার অপচেষ্টা মাত্র। কারণ রিমান্ডে নিশ্চয়ই জিসা মনির ছবি, মোবাইলে কথিত প্রেমিক আবদুল্লাহর ফোনের কললিস্ট দেখানো হয়েছে। সেখানে অন্য কোনো ঘটনায় তাদের জড়িত থাকা বা এ ঘটনায় এমন জবানবন্দি দেয়ার প্রশ্নই আসে না।
অ্যাডভোকেট রোকন উদ্দিন বলেন, রাতারাতি হিরো হওয়ার মনোবাসনা থেকেই পুলিশ তিন নিরপরাধকে মধ্যযুগীয় কায়দায় রিমান্ডে নির্যাতন করে ধর্ষণ ও হত্যার নাটক সাজিয়েছে।
তিনি দাবি করেন, বাদীপক্ষ মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ও আসামিরা তাদের জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করলেও পুলিশ সহযোগিতা করছে না।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে সদর থানার ওসি আসাদুজ্জামান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শামীমকে ফোন করলে তারা এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
উল্লেখ্য, গত ৪ জুলাই নিখোঁজ হয় নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ পাক্কারোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী। বাবার দায়ের করা অপহরণ মামলায় এক মাস পর একই এলাকার রকিব, আবদুল্লাহ ও খলিলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ঘটনার দেড় মাস পর ওই কিশোরী রোববার পরিবারের কাছে ফিরে এলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
উৎসঃ দৈনিক যুগান্তর