এম,এস সেকিল চৌধুরীঃ বিদেশে বাংলাদেশের শ্রম বাজার নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা অনিশ্চয়তা। একেতো কোভিড-১৯ এর প্রকোপে বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থবিরতার কারণে সংকুচিত হচ্ছে কর্মক্ষেত্র অন্যদিকে বিদেশে শ্রমবাজার নিয়ে গুটিকয় প্রভাবশালী অসাধু দালাল ব্যবসায়ীদের কৃতকর্মের জন্য নানা দেশ থেকে আসছে দুঃসংবাদ। কুয়েতে এক অসৎ বাংলাদেশি রিক্রুটিং ব্যবসায়ীর কারণে নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এই অসৎ ব্যবসায়ী আবার তার প্রভাব বিস্তার করার জন্য দেশের জাতীয় সংসদে এমপির একটি পদ অর্জন করেছেন। শুধু নিজে এমপি হয়েই ক্ষান্ত হননি স্ত্রীর জন্যও এমপি‘র আরেকটি পদ জোগাড় করেছেন। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সৎ ও আর্দশিক রাজনীতিবিদদের জন্য একটি অশনি সংকেত। এই অসাধু কর্মকাণ্ডের জন্য শুধু কুয়েতেই নয় গোটা অঞ্চলে আমাদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে উঠেছে।
বেকারত্বের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে বড়বড় অর্থনীতির দেশ। আমেরিকায় সপ্তায় সপ্তায় মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ বেকার ভাতার জন্য আবেদন করছেন।
সরকার নানাভাবে নাগরিকদের সহায়তা করার চেষ্টা করছে। সাপ্তাহিক ভাতা প্রদান, বাড়িভাড়া প্রদানে সহায়তা, এককালীন নাগরিক প্রতি ১২০০ ডলার প্রণোদনা প্রদান, দ্বিতীয় দফায় পুনরায় এই পরিমাণ প্রদানের প্রক্রিয়া গ্রহণ, স্কুল ছুটি থাকা সত্বেও ছাত্রদের টিফিন মানি প্রদান ইত্যাদি নানা প্রক্রিয়ায় মানুষকে উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজস্ব রাষ্ট্রগুচ্ছকে কোভিডকালীন সময়ে নানা সহায়তার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে, ফলে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সহায়তায় আগামী দিনগুলোতে তাদের মধ্যে সংকোচন দেখা যাবে, অত্যাবশ্যকীয় সহায়তা ছাড়া আনুসাঙ্গিক নানা অর্থায়ন বন্ধ বা কমে যেতে পারে।
বৃটেন আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থনৈতিক মন্দা ঘোষণা করেছে। তবে নাগরিকরা যাতে আর্থিকভাবে সচল থাকতে পারে সেজন্য করোনাকালে নানা প্রকার প্রণোদনা ভাতা প্রদান করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের নিজেদের নাগরিক ও ব্যবসা বাণিজ্য সচল রাখতে দিচ্ছে নানা আর্থিক সহায়তা, শুধু বিপদে আছেন বিদেশি শ্রমিক ও আমাদের প্রবাসী ব্যবসায়ীরা যারা নিজেদের দেশীয় ব্যাংকের সঙ্গে বিদেশের শাখা সমূহে ব্যবসা করছেন।
দেশে দেশে অর্থনীতিতে চলছে নানা সমীকরণ। চীন-আমেরিকার বাণিজ্য ও প্রভাব বলয় সম্প্রসারণের প্রয়াস, আরব আমিরাত-ইসরাইল চুক্তি এ সবই এই নতুন মেরুকরণের নির্যাস।
কোভিড পরবর্তী অর্থনীতি ঢেলে সাজাতে শুরু করেছে পৃথিবীর নানা দেশ। ইমিগ্রেন্ট প্রধান দেশ হিসেবে খ্যাত খোদ মার্কিন মুল্লুকে নানা ভাবে অভিবাসন ও কর্মক্ষেত্রে বিদেশিদের প্রবেশ সংকুচিত করছেন তাদের প্রেসিডেন্ট। বিভিন্ন আরব দেশ নিজেদের জনসংখ্যার অনুপাতে বিদেশি কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা করছে। ফলে এসব দেশে বাংলাদেশের বর্তমান শ্রম বাজার ছোট হবে এবং নতুন কর্মী প্রেরণ বাধাগ্রস্ত হবে।
কোভিড-আক্রান্ত ২০২০ সালে এখন পর্যন্ত বিদেশে শ্রমিক গেছেন ১ লাখ ৮১ হাজার ২১৮ জন। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় আনুপাতিক হারে অনেক কম। ২০১৯ সালে বিদেশের শ্রম বাজারে গেছেন ৭ লাখ ১৬৯ জন কর্মী এবং বাংলাদেশ পেয়েছে ১৮.৩৫৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স।
কোভিডের কারণে শ্রমিক প্রেরণ বন্ধ রয়েছে। সব খরচ ও আয়োজন সম্পন্ন করে বসে আছেন হাজার হাজার বিদেশগামী কর্মী। গত দু’মাস যাবত কোন কর্মী বিদেশ যেতে পারেনি। সামনের দিনগুলোতে রেমিটেন্সের প্রভাব পড়বে ব্যাপকভাবে। চোখে অন্ধকার দেখছেন এ খাতের ব্যবসায়ী ও নিয়োজিত কর্মীবৃন্দ, এদের টেনে তুলতে হবে। প্রায় ১৬০০ লাইসেন্সধারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অর্ধলক্ষ জনবল নিয়ে গত চার মাস যাবত চোখে অন্ধকার দেখছেন। যাদের মাসিক বেতন খাতে ব্যয় রয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এই ব্যবসায়ীদের কাছে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ হাজার পরিশোধিত ভিসা রয়েছে। কিন্তু কর্মী যেতে পারছে না, এই খাতে ইতিমধ্যে প্রায় ১২ থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যবসায়ীদের আটকে আছে। এই ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিতে পারলে প্রবাসী শ্রমবাজার রক্ষায় এরা ভূমিকা রাখতে পারবে।
১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার মানুষ বৈধ প্রক্রিয়ায় বিশ্ব শ্রম বাজারে প্রবেশ করেছেন, অবদান রাখছেন বিশ্ব অর্থনীতিতে। এ সময়কালে বাংলাদেশ পেয়েছে ২১৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এ পরিসংখ্যান শুধু সুনির্দিষ্টভাবে বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য যারা গেছেন তাদের। এছাড়া বহু বাংলাদেশি নানাভাবে বিদেশে গিয়ে প্রবেশ করেছেন শ্রম বাজারে অথবা নিয়োজিত হয়েছেন স্বকর্মসংস্থান প্রকল্পে। এদের কেউ কেউ অন্যান্য দেশের নাগরিকত্বও গ্রহণ করেছেন অথবা স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে ব্যবসা বাণিজ্য অথবা শ্রম বাজারে নিযুক্ত আছেন। প্রতিবছর ৬ থেকে ৭ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বব্যাপী শ্রম বাজারে প্রবেশ করছে। এই শ্রম শক্তি যে রেমিটেন্স প্রেরণ করে তার ১০০% অর্থই দেশে থাকে।
জুলাই ২০২০ সালে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স এসেছে ২.৬ বিলিয়ন ডলার, যা মাসিক হিসেবে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। ৩০শে জুন ২০২০ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ ছিল ৩৬.০১৬ যা ৩১শে জুলাই বেড়ে হয়েছে ৩৭.২৮৭ বিলিয়ন ডলার, এটিও সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের রেকর্ড। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রির্জাভের অন্যতম যোগানদাতা এবং একক বৃহত্তম খাত। এই রিজার্ভ দিয়ে দেশের ৮ থেকে ৯ মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা যায়। সাধারণত ৩ থেকে ৪ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলেই ধরে নেয়া হয় সে দেশের রিজার্ভ সন্তোষজনক।
গত এক দশকে প্রবাসী কর্মসংস্থান খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে প্রবাসে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩৯ লাখ ৮১ হাজার ৩১০ জনের এবং এই সময়ে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে ৪৯.৬১ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল এই ১০ বছরে প্রবাসে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬১ লাখ ৫৭ হাজার ৯৭৬ জনের এবং এই সময়ে প্রবাসী আয় হয়েছে ১৪২.৪২ বিলিয়ন ডলার। গত এক দশকে প্রবৃদ্ধির হার কর্মসংস্থানে ৫৪.৭% এবং প্রবাসী আয় খাতে ১৮৭.১%। এই অর্জনের পেছনে জনশক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
২০১৯ সালের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ সময়ে যে পরিমাণ কর্মী বিদেশে গেছেন তার ৪৩.৫৫ % ছিলেন দক্ষ অর্থাৎ মোট কর্মীর অর্ধেকের কম। আর পেশাগত দক্ষতা নিয়ে বিদেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা আরো হতাশাজনক, মাত্র ০.২৭%। সুতরাং প্রবাসী কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশের মনযোগ দিতে হবে।
১৩ মিলিয়ন বাংলাদেশি প্রবাসে থাকেন কর্ম উপলক্ষে। এছাড়া আরো প্রায় ২ মিলিয়ন থাকেন দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে। সর্বমোট ১৫ মিলিয়ন প্রবাসী দেশের কোন কিছু ভোগ করেন না। উপরন্তু প্রতিজন প্রবাসী গড়ে ৫ জনের একটি পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক জীবনের সংস্থান করেন। সে হিসেবে ৭৫ মিলিয়ন মানুষের জীবন যাপনের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন প্রবাসীরা। পরিবারের নানাবিধ দায়িত্ব পালন ছাড়াও এই প্রবাসীরা বহুমুখী সামাজিক দায়িত্বও পালন করেন। এরা নিজেদের এলাকায় স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বহু সেবামুলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। প্রবাসীরা নিজে বিনিয়োগ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের বিনিয়োগে বিনা সুদে অর্থ ধার দিয়ে এক অনন্য সুন্দর অবদান রেখে চলেছেন তারা।
দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এই প্রবাসীরা এখনো দেশের বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আসেননি। লাগাতারভাবে আর্থ-সামাজিক জীবনে অবদান রাখার কারণে প্রবাসীরা যেখানে অগ্রগামী সুবিধা পাওয়ার দাবিদার সেখানে বরং অনেক ক্ষেত্রে এরা বিড়ম্বনার শিকার হয় দেশে ও বিদেশে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কতিপয় অসৎ সুবিধা লোভী মানুষ নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য প্রবাসীদের হয়রানি করে, নানা রকম মামলায় জড়ায় প্রবাসীদের, তাদের জমি ও সম্পত্তি বেদখল করে। বিভিন্ন প্রশাসনিক কাঠামোতে কর্মরত মানুষের মধ্যে কেউ কেউ প্রবাসীদের অযথা হয়রানি করেন নিজেদের অন্যায্য স্বার্থ সিদ্ধির জন্য।
সরকারি পরিচালন নীতিমালায় প্রবাসীদের সহজ সুবিধা প্রদানের নির্দেশনা থাকলেও অসাধু লোকের জন্য প্রবাসীরা বিড়ম্বনার শিকার হন।
বিশ্বের ১৬৮টি দেশে প্রবাসীরা বসবাস করেন। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে নানামুখী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্য ও তেল নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোতে বাংলাদেশিরা বেশি কাজ করছেন। সেদিক থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর গন্তব্যস্থল সৌদি আরব। মোট প্রবাসীর ৩১.৮৯% কাজ করেন এই দেশটিতে। এর পরেই রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, এখানে কাজে গেছেন ১৮.৬৮% প্রবাসী। এরপর ওমান ১১.৮২%, মালয়েশিয়া ৮.৩২% এবং কাতার ৬.৩৬%। রেমিটেন্স প্রেরণের দিক থেকেও এদেশগুলো অগ্রগামী। ২০১৯ সালের প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, মোট রেমিটেন্স ১৮.৩৫৪ বিলিয়নের ১৯.৮৭% অর্থাৎ ৩.৬৪৬ বিলিয়ন ডলার এসেছে সৌদি আরব থেকে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ১৪.৮৯% অর্থাৎ ২.৭৩২ বিলিয়ন। প্রতিবছরের রেমিটেন্স আসার ট্রেন্ড একই রকম। কর্মক্ষেত্রের দিক দিয়েও এই দুই দেশ এগিয়ে। এই দুই দেশ অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫০.৫৭% প্রবাসীর গন্তব্যস্থল। এরপর রয়েছে ওমান, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর, কুয়েত ও বাহরাইন।
করোনাভাইরাস আক্রান্ত বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রবাসী জনগোষ্ঠি ও প্রবাসী আয় এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখী হয়েছে। কর্মহীন হচ্ছে মানুষ, নিম্নগামী দেশগুলোর অর্থনীতি। উৎপাদনশীল খাত, বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন ও বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েছে। খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিশ্বে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দিন দিন মানুষের কর্মহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজনেস হাউজগুলো চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত হয়েছে। নতুন কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি দূরে থাক প্রতিনিয়ত বাণিজ্য খাতগুলো থেকে লোক ছাঁটাই ও বেতন কমানোর বা বেতন দিতে না পারার খবর আসছে। কবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে কেউ জানেনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাধ্যমত প্রয়াস চালালেও নির্দিষ্ট করে কিছুই বলতে পারছে না এই অচেনা সর্বনাশা শত্রুর ব্যাপারে। কোভিড-১৯ বিশ্বের সকল শক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রর্দশন করে চালিয়ে যাচ্ছে তার তাণ্ডব।
এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীদের অনেকেই গত ৩-৪ মাসের কর্মহীনতায় এখন নিঃস্ব, হয়ে দেশে ফিরছেন। যে সকল প্রবাসী ইতিমধ্যে দেশে এসেছেন তারা চোখে অন্ধকার দেখছেন, না পারছেন কইতে না পারছেন সইতে। একদিন যে প্রবাসীরা নিজের পরিবার চালাতেন এবং প্রতিবেশী ও সমাজকে সহায়তা করতেন আজ তারা অসহায়। কর্মহীন এসব প্রবাসীদের দিকে খাদ্যাভাব ও অর্থাভাব ধেয়ে আসছে। যে রাষ্ট্রযুগলকে (নিজ দেশ ও কর্মক্ষেত্রের দেশ) প্রবাসীরা এতদিন দিয়ে এসেছেন আজ সেই রাষ্ট্রের কাছে এরা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে তাগাদা দিচ্ছে নিজেদের লোক ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। একে তো ১৬০ মিলিয়ন মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ হিমশিম খাচ্ছে কোভিড মোকাবিলায়, উপরন্তু দেশে ফেরত আসা সোনার ছেলেরা বেকারত্ব নিয়ে এসেছে এবং আরো কর্মহীন প্রবাসী দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন।
বাংলাদেশ তার সাধ্যমত লড়াই করে যাচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতা, রোগ নিয়ন্ত্রণের সীমিত সক্ষমতা, স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুল আয়োজন সব মিলিয়ে গেল এক দশক ধরে ৮ এর বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী মধ্যম আয়ের দেশটি এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। মানুষের মনোবল ও সীমিত সম্পদকে পুঁজি করে লড়াকু মানসিকতায় এগুচ্ছে দেশটি। আগামী দিনগুলোতে নানা অজানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে দেশটিকে। হঠাৎ করে কর্মহীন হয়ে পড়া দিন মজুর, নিম্ন আয়ের মানুষ, ছোট উদ্যোক্তা ও উৎপাদন খাতের কর্মী বাহিনীর পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর কর্মসংস্থানের অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন বাংলাদেশ।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের জন্য নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান, চলমান বাজার বজায় রাখা, বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থার সহায়তা ও কার্যকর সহযোগিতা অর্জনের প্রয়াস চালানো, প্রবাসীদের জন্য স্ব স্ব উপজেলায় স্ব-কর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণ, বিভিন্ন আকারের বিনিয়োগে সহজলভ্য ব্যাংক ঋণ ও নীতি সহায়তা জোরদার করতে হবে। প্রবাসীদের বিভিন্ন দেশে কাজের সুবাদে অর্জিত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তাদেরকে নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনায় উৎসাহ ও সহায়তা দেয়া ইত্যাদি কাজে রাষ্ট্রকে আজ প্রবাসীদের পাশে দাড়াঁতে হবে। বিভিন্ন দেশে অনাবাদি জমি আবাদে ও কৃষিখাতে প্রবাসীদের নিয়োজিত করার প্রয়াস চালাতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করে ব্যাপক জব সার্চের পদক্ষেপ নিতে হবে। উন্নত দেশ বিশেষ করে ইউরোপ আমেরিকার দেশ গুলোতে প্রবাসীদের জন্য কৃষিকাজ ও খাদ্য উৎপাদনে কর্ম-সংস্থানের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এতে দুই দেশই উপকৃত হবে এবং অনাগত দিনে খাদ্য ঘাটতির যে শংকা দেখা দিয়েছে তা দূরীভূত হবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশিদের জন্মগতভাবে কৃষিকাজে বিশেষ দক্ষতা রয়েছে, যা এই সময় অন্যান্য দেশ কাজে লাগাতে পারে। প্রবাসে বর্তমান বাজার ধরে রাখা ও নতুন বাজার অন্বেষণে জনশক্তি ব্যবসায়ীদের কাজে লাগানো দরকার। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোকে অগ্রাধিকার কাজ হিসেবে এটিকে গণ্য করার নির্দেশনা পাঠাতে হবে।
কোভিডের কারণে আমুল বদলে যাচ্ছে বিশ্ব পরিস্থিতি। সবাই তাদের আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনা কোভিডের সঙ্গে খাপ খাইয়ে তৈরি করছে, নতুন ছকে সাজাচ্ছে তাদের কর্ম-পরিকল্পনা। সুতরাং বাংলাদেশকেও নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, বেরিয়ে আসতে হবে গতবাধাঁ কর্ম পদ্ধতি থেকে।
বিভিন্ন দেশে বিদেশিদের ব্যাপারে যে সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হচেছ তা সামাল দিতে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগ নেয়ার বিকল্প নেই। বাজার ধরে রাখতে বিকল্প কর্ম সংস্থান পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। নির্মাণ ও পরিচ্ছন্নতা শ্রমিককে কৃষি শ্রমিক বা অন্য উৎপাদনশীলখাতে নিয়োগের পথ খুঁজতে হবে।
যারা এ খাত নিয়ে নানা অন্যায্য কাজ করেছেন তাদের কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে। যে যত প্রভাবশালী ও অর্থবান হোক তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের ভাবমুর্তি উন্নয়নের প্রয়াস নিতে হবে। অন্যথায় মানবপাচারকারী দেশের তকমা নিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে বিতাড়নের শিকার হবে বাংলাদেশি শ্রমিকরা। আশার কথা সরকার ও মন্ত্রণালয় নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছেন, এগুলোর সফল সমাপ্তিই নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রমবাজারকে দিতে পারে কিছুটা স্বস্তি।
—
লেখক- ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এর প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি ও লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের প্রাক্তন গর্ভণর।
চেয়ারপার্সন সেন্টার ফর এনআরবি
Email: [email protected]