করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা বিরাজকরছে। কাজ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। এ পরিস্থিতিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি-জুন সময়ে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী বাংলাদেশী দেশে ফিরেএসেছেন। দেশে ফেরার পর তাদের প্রায় ৭০শতাংশই পড়েছেন জীবিকা সংকটে। আর ঋণেরবোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন ৫৫ শতাংশ বিদেশফেরত।
সম্প্রতি দেশের ১২ জেলায় বিদেশফেরতদের ওপরআন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।গতকাল ‘র্যাপিড অ্যাসেসমেন্ট অব নিডস অ্যান্ডভালনারেবিলিটিস অব ইন্টারনাল অ্যান্ডইন্টারন্যাশনাল রিটার্ন মাইগ্র্যান্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে ওই গবেষণার ফলাফলপ্রকাশ করেছে আইওএম। সরকারের সঙ্গে সমন্বয়করে মোট ১ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশফেরতনাগরিকের ওপর গত মে ও জুলাইয়ে এ গবেষণাচালায় আইওএম।
এ গবেষণায় ১২টি জেলা বেছে নেয়া হয়েছে, তারমধ্যে সাতটিই ভারত সীমান্তবর্তী। ফলে জরিপেঅংশ নেয়া বিদেশফেরতদের বড় অংশ তথা ৩০শতাংশই ছিলেন ভারতফেরত। এছাড়া ১৫ শতাংশ সৌদি আরব থেকে, ১৩ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, ৮ শতাংশ ইতালি ও ৮ শতাংশ ওমানথেকে ফিরে এসেছেন।
K
অভিবাসী এসব বাংলাদেশীর দেশে ফেরার প্রধান কারণই ছিল কভিড-১৯। আইওএমের করা প্রশ্নে২৯ শতাংশ উত্তরদাতাই বলেছেন, তাদের নিজদেশে ফিরতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তবেকভিড-১৯ নিয়ে উদ্বেগে নিজ থেকেই দেশেফিরেছেন ২৩ শতাংশ। তারা বলেছেন, করোনা নিয়েতারা দুশ্চিন্তায় ছিলেন এবং পরিবারের কাছেফেরত আসতে চেয়েছেন। ২৬ শতাংশ জানান, তাদের পরিবার তাদের ফেরত আসতে বলায় তারাফিরে এসেছেন। ৯ শতাংশ জানান, সীমান্ত বন্ধ করেদেয়া হলে আটকে পড়ার ভয়ে তারা ফেরতএসেছেন।
দেশে ছুটিতে এসে করোনার কারণে আটকে পড়াঅভিবাসীর সংখ্যাও কম নয়। ফিরতে না পেরেতারাও এখন সংকটময় সময় পার করছেন।কর্মস্থলে ফেরার আকুতি থাকলেও সংশ্লিষ্ট দেশেরবিধিনিষেধের কারণে ফিরতে পারছেন না তারা।চলমান করোনা পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোবিদেশীদের ঢুকতে দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়িআরোপ করেছে।
বিদেশীদের নিজ সীমায় প্রবেশই করতে দিচ্ছে নাকাতার ও কুয়েত। শ্রমিক ভিসা ইস্যু করা কমিয়েদিয়েছে বাহরাইন, লেবাননসহ অন্য দেশগুলোও।রেমিট্যান্স আয়ের বৃহৎ ক্ষেত্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানিকেবিপন্ন করে তুলেছে কভিড-১৯। মধ্যপ্রাচ্যেরদেশগুলোয় বর্তমানে অন্তত ৪০ লাখ বাংলাদেশীবিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। অভ্যন্তরীণ চলাচলসীমিত করে দেয়ার কারণে ব্যাঘাত ঘটছে তাদেরপেশাগত জীবনযাত্রায়ও।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজারসৌদি আরব। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরও দেশথেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী গিয়েছিলেন সৌদিআরবে, প্রায় ৫৭ শতাংশ। তালিকার দ্বিতীয় ওতৃতীয় অবস্থানের দেশগুলোও মধ্যপ্রাচ্যের। দেশ দুটিহলো যথাক্রমে ওমান (১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ) ওকাতার (৭ দশমিক ১৮ শতাংশ)।
ছুটিতে এসে ফিরতে না পারা কিংবা করোনারকারণে ফিরে আসা অভিবাসীরা জীবিকা ও আর্থিকসংকটে পড়েছেন। দেশে তাদের কোনো আয়-উপার্জন নেই। এছাড়া স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়সহ নানাধরনের সমস্যায় আছেন তারা। হঠাৎ করেঅভিবাসীদের ফিরে আসার ঘটনায় বিরূপ প্রভাবপড়েছে সারা দেশে রেমিট্যান্সনির্ভর জনগোষ্ঠীরওপর। কারণ একেকজন অভিবাসী গড়ে তারপরিবারের তিনজন সদস্যকে সহায়তা করেন।
বিদেশফেরত বাংলাদেশীদের জন্য আরেক বড় চাপহলো ঋণের বোঝা। অভিবাসী শ্রমিকদের বড় অংশইভালো উপার্জনের আশায় বড় অংকের অর্থ খরচকরে বিদেশ গিয়েছিলেন। আইওএমের গবেষণাবলছে, বিএমইটির মাধ্যমে বা সরকারি চ্যানেলেবিদেশে যেতে প্রতিজন অভিবাসীর খরচ পড়েছেগড়ে ২ লাখ ৩২ হাজার টাকা। বিএমইটির মাধ্যমেযারা যাননি তাদের খরচ পড়েছে আরো বেশি, গড়ে৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। অধিকাংশ অভিবাসীইখরচের এই অর্থ সংগ্রহ করেছেন ঋণ নিয়ে।
আইএমওকে সাক্ষাত্কার প্রদানের সময় ৫৫ শতাংশজানান, তাদের ওপর বর্ধিত শোধ না করা ঋণেরবোঝা রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ পরিবার ওবন্ধুর কাছে ঋণগ্রস্ত, ৪৪ শতাংশ ক্ষুদ্র ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (এমএফআই), স্বনির্ভর দলএবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণগ্রস্ত। পরিবারও বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণকারীদের ৮৬শতাংশ বিনা সুদে ঋণ নিয়েছেন। অন্যদিকেএমএফআই, এনজিও এবং বেসরকারি ব্যাংক থেকেঋণ গ্রহণকারী ৬৫ শতাংশকে ঋণের বিপরীতে ১০থেকে ১৫ শতাংশ সুদ বহন করতে হচ্ছে। মহাজন বাসুদে টাকা ধার দেন এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকেনেয়া ঋণের ক্ষেত্রে ৬২ শতাংশ ঋণগ্রহীতাকে সুদগুনতে হচ্ছে ৫০ থেকে ১৫০ শতাংশ।
আইওএম বাংলাদেশের মিশনপ্রধান গিওরগিগিগাওরি বলেন, কভিড-১৯ মহামারীর সময়সবচেয়ে বিপদাপন্ন গোষ্ঠীদের মধ্যে রয়েছেনঅভিবাসী কর্মীরা। বৈশ্বিক চলাচলের ওপরআরোপিত নতুন নিষেধাজ্ঞা এবং কভিড-১৯মহামারী সৃষ্ট মন্দার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছেবাংলাদেশের অভিবাসী কর্মী এবং রেমিট্যান্সনির্ভরজনগোষ্ঠীর ওপর।
কভিড-১৯ অভিবাসী কর্মীদের সবচেয়ে বেশিবিপদাপন্ন করেছে। উপার্জন ব্যবস্থা, সামাজিক সেবা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সহায়তার নেটওয়ার্কেরঅভাবে হাজার হাজার অভিবাসী কর্মী নিজ দেশেফিরতে বাধ্য হয়েছেন। ৬৪ শতাংশ অভিবাসীইজানিয়েছেন যে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে দেশেতথ্য ও স্বাস্থ্যসেবা পেতে সমস্যার সম্মুখীন হতেহয়েছে তাদের। যে কারণে একপর্যায়ে ফিরে আসতেবাধ্য হয়েছেন তারা।
পরিস্থিতির চাপে দেশে ফিরে এলেও ভবিষ্যৎপরিকল্পনা সম্পর্কে প্রায় ৭৫ শতাংশ বিদেশফেরতনাগরিক জানান, তারা আবার অভিবাসনে আগ্রহী।তাদের মধ্যে ৯৭ শতাংশই কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবেরআগে যে দেশে কাজ করতেন সে দেশেই পুনরায়অভিবাসনে ইচ্ছুক। অন্যদিকে, ৬০ শতাংশঅংশগ্রহণকারী আরো ভালো বেতনের চাকরিনিশ্চিতে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে আগ্রহী।