আব্দুল্লাহ আল শাহীন, ইউএই থেকেঃ মরুর দেশের গরম সম্পর্কে ইসলামের সোনালি যুগের ইতিহাস পড়ে ধারণা পেয়েছেন৷ বিশেষ করে নবী রাসুলদের জীবনী পড়লে কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন। আরবের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীরা নিজেদের জীবনকে রঙিন করতে বা অর্থনৈতিক স্থিরতা ফেরাতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন৷ সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ১০ লক্ষাধিক বাংলাদেশির বসবাস। এখানে সিংহভাগ প্রবাসী শ্রমিকের ভিসায় রয়েছেন। তারমধ্যে খোলা আকাশের নিচে কাজ করার সংখ্যা কিন্তু কম নয়৷
নির্মাণ শ্রমিক, ক্লিনার কোম্পানি, বাইক রাইডার, বিভিন্ন দোকান ও পানি কোম্পানির হোম ডেলিভারি সার্ভিসসহ এসব কাজে বাংলাদেশিদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি৷ উল্লেখিত কাজ গুলোতে যারা কর্মরত তাদের কাছে জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত খুবই কষ্টের। এছাড়া সবার বেলায় রান্না ও গোসলের বিরক্তিকর অধ্যায় তো রয়েছেই৷
গেল দুই বছর থেকে প্রায় ২-৩ লাখ যুবক আমিরাতে ভিজিট ভিসায় এসেছেন। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ইউরোপ যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে আমিরাতে আসেন৷ বাদবাকি সকলেই ভিজিট ভিসাকে কাজের ভিসায় পরিবর্তন করেছেন৷ নিশ্চয় ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের সকলেই আমিরাত প্রবাসীদের মানবেতর জীবনযাপন সম্পর্কে অবগত আছেন৷ কাজের সঙ্কট, কাজ না পেয়ে রাস্তাঘাট ও পার্কে ঘুমানোর সংবাদ সবারই জানা৷ এই বিষয়ে অন্য একদিন আলোচনা করবো৷ মরুভূমির উত্তপ্ত গরম নিয়ে আজ থাকতে চাচ্ছি৷
সংখ্যায় খুব কম হলেও অনেক প্রবাসী মরুভূমিতে উট চড়াতে দেখা যায়৷ কিছু সংখ্যক প্রবাসী কৃষি কাজে রয়েছেন। তাদের শরীর সম্পূর্ণ কাপড়ে ঢাকা থাকা সত্ত্বেও অল্প দিনে শরীরের রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়৷ উত্তপ্ত মরুভূমির গরমের ব্যাপারে একটু উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, আপনারা নিশ্চয় সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই দেখেছেন গরমে গাছের ডালে ডালে স্পর্শ লেগে আগুন ধরে যায়, গাড়ি পার্কিং-এ থাকা অবস্থায় গরমে পুড়ে যায়, রাস্তায় পানি ছিটিয়ে দিলে সেকেন্ডে শুকিয়ে যায়৷
এমন পরিস্থিতিতে চিন্তা করেন ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় প্রবাসীরা কিভাবে কাজ করেন৷ তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি হলেও অনুভব হয় ৬০ এর বেশি৷ যদিও আমিরাত সরকার মানবিকতার চর্চায় প্রতি ১৫ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ তিন মাস দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতি আইন রয়েছে। প্রতিবছর যখন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করে, তখন কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। এসময় কোনো প্রতিষ্ঠান এই আইন অমান্য করে, তবে সেই প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার দিরহাম পর্যন্ত জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিলের মতো শাস্তি দেওয়া হবে। পাশাপাশি শ্রমিকের বেলায় পাঁচ হাজার দিরহাম জরিমানার আইন রাখা হয়েছে।
কি পরিমাণ গরম হলে পরে একটি রাষ্ট্র এমন আইন করতে পারে? তা ভাবুন! এক মিনিটের জন্য বাসা কিংবা অফিস থেকে বের হয়ে বাহিরে দাঁড়ালে পুরো শরীর ভিজে যাওয়ার উপক্রম হয়৷ যারা হোম ডেলিভারির কাজ করেন, নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে আছেন তাদের পরিস্থিতি নিজ চোখে না দেখলে ভাবতেই পারবেন না৷ এতো কষ্টের মাঝেও একজন শ্রমিককে জিজ্ঞেস করে দেখবেন এই গরমে কিভাবে কাজ করেন? সে হাসিমুখে জবাব দিয়ে বলবে, ‘একবার পুরো ভিজে গেলে আর তেমন গরম লাগে না।’ কর্মরত অবস্থায় গায়ের কাপড় বারবার শুকায় আর বারবার ভিজে। নির্মাণ শ্রমিক বা হোম ডেলিভারির কাজ যারা করেন তারা শুধু নয় যেকোনো কাজের লোকেরা এই গরমের তীব্রতায় দিশেহারা হতে বাধ্য হোন৷ বিশেষ করে রান্না করতে গিয়ে একপ্রকার বৃষ্টির পানিতে নামলে পরে যেমন ভিজে যেতে হয় তেমনই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷ যাদের রান্নাঘরে এসি আছে তাদের বেলায় একটু কমই অনুভূতি হয়৷ ওয়াশরুমের পানির গরম যেন চুলার ফুটন্ত পানি!
মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা শ্রম বেশি দেন, কষ্ট বেশি করেন, দেশ থেকে দূরে বেশি সময় থাকেন, গরমের তাপে শরীর পুড়ান। এতো কিছুর পরেও আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে খুবই কম৷ এভাবেই দূর প্রবাসে পুড়ছে বাংলার মানবসম্পদ, পুড়ছে মায়ের আদরের সন্তান।
লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল শাহীন
সাংগঠনিক সম্পাদক
বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ইউএই