তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের হাওর অঞ্চলের কৃষকদের একমাত্র সম্বল হাওরে উৎপাদিত বোরো ফসল। হাওর পাড়ের কৃষক নির্ভরশীল বোরো ধানের উপর। তাদের পুরো বছরের খোরাকী এবং সকল ব্যয় চলে ধান বিক্রির টাকা দিয়ে। কৃষকরা ধার দেনাও শোধ করেন ধান বিক্রির টাকা থেকে।
তবে এবছর বোরো মৌসুমে দীর্ঘ মেয়াদী খরা, স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের তদারকির অভাব ও পানি সেচের সুবিধা না থাকায় জেলার হাওরগুলোতে কৃষকের রোপণকৃত ব্রি-২৮ জাতের ধানে চিটা ধরায় চরম লোকসানে পড়েছেন হাওর পাড়ের কয়েক হাজার প্রান্তিক কৃষক ও বর্গা চাষী। কোথাও পুরো জমির ধানে চিটা ধরায় শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে ধান কেটে লাভবান হবেন না দেখে অনেক কৃষক ধান কাটতে অনিহা প্রকাশ করছেন। তবে জেলার সচেতন মহল বলছেন, মৌসুমের শুরু থেকে কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা তৎপর হলে এমনটি হতো না।
মৌলভীবাজার জেলায় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওর, কাউয়াদীঘি হাওর, হাইল হাওরসহ ছোট বড় বেশ কয়েকটি হাওর রয়েছে। এসকল হাওরের প্রধান ফসল বোরো ধান। কিন্তু ওই সকল হাওরে ভালো ফলন না হওয়ায় চরম লোকসানে পড়েছেন কৃষকরা।
একদিকে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি অন্য দিকে, বোরো চাষাবাদে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভেঙ্গে পড়েছে তাদের জীবনমান।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৬ হাজার ৫’শ ৭০ হেক্টর। চাষাবাদ হয়েছে ৫৭ হাজার ৩’শ ৪৫ হেক্টর। এর মধ্যে ব্রি-২৮ জাতীয় আগাম ধান চাষবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ৯২৫ হেক্টর জমিতে।
এদিকে, জেলার সচেতন মহল ও কৃষকরা মন্তব্য করছেন ব্রি-২৮ ধানে বড় ধরনের ক্ষতির পরেও জেলা কৃষি বিভাগ কিভাবে বলছে এবারও তারা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের এ জরিপ মাঠের বাস্তব চিত্রের সাথে ভিন্ন।
হাওরের মধ্যে ভালো ফলনশীল জমিতে ধান কাটা উৎসবের আয়োজন করে জেলা কৃষি বিভাগ। এই জমিতে উৎপাদিত ধান দিয়েই পুরো হাওরে আবাদকৃত জমির গড় উৎপাদন নির্ধারণ করা হয়। যার ফলে হাওরে উৎপাদিত ধানের প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনা।
জানা যায়, গত বছর হাওরের যে এলাকায় (মৌজায়) ব্রি-২৮ জাতীয় ধান প্রতি বিঘাতে ১৫ থেকে ২০ মণ ধান পেয়েছেন কৃষকরা। এ বছর ওই এলাকায় ব্রি-২৮ ধান প্রতি বিঘাতে কৃষকরা পাচ্ছেন ৪ থেকে ৫ মণ।
হাকালুকি হাওরের কৃষক আব্দুল হান্নান জানান, তিনি এ বছর ৮ বিঘা জমি চাষ করেছেন। এর মধ্যে ২ বিঘা জমিতে ব্রি ২৮ ধান চাষ করেছিলেন। পুরো দুই বিঘা জমির ফসলে চিটা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, কৃষি বিভাগ থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা পাননি।
কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের কৃষক রিয়াজুর রহমান জানান, কৃষি বিভাগ কাগজে কলমে ফলন বাড়িয়ে দেখাতে ব্যস্ত। কৃষকের সমস্যাগুলো সমাধানে এগিয়ে আসেনি। একই কথা বলেন কাউয়াদিঘি হাওর ও হাইল হাওরের কৃষক মাহমুদুল হাসান, খায়রুল ইসলামসহ কয়েকজন।
ভাটেরা ইউনিয়নের বালিধারা গ্রামের তাজ উদ্দিন জানান, ব্রি ২৮ ধানে চিটা থাকায় কৃষকরা সীমাহীন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
হাওর কাউয়াদীঘির পূর্ব পারের পশ্চিম ভাগ গ্রামের জয়নাল মিয়া জানান, ধানে চিটা ধরার কারণে আমরা অনেক লোকসানে পড়েছি। গত বছর ২ বিঘা জমিতে ৪০ মণ ধান পেয়েছিলাম। এবার ১০ মণ ধান পেতে পারি।
একই এলাকার খায়রুল, শহিদ মিয়া, সাদিকসহ অনেকে জানান, এ বছর খরার কারণে পানির অভাবে আমাদের জমিতে ধানে চিটা ধরে অনেক জমির ধান কাটার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আবার যে সকল জমিতে ধান হয়েছে তার উৎপাদন অনেক কম।
এই হাওরের ছালিক মিয়া জানান, সময় মতো বৃষ্টি না হওয়াতে এবং নদী, খালে পানি না থাকায় জমিতে পানি দিতে পারিনা। তাই, আমার ১৮ বিঘা ব্রি-২৮ জাতের ধানে জমি নষ্ট হয়েছে।
হাকালুকি হাওর পারের ভুকশিমইল ইউনিয়নের কৃষক মো. ইদই মিয়া, কাদির মিয়া, গিয়াস উদ্দীনসহ অনেকেই জানান, খরার কারণে এ বছর হাওরে ব্রি-২৮ জাতীয় ধানে চিটা ধরেছে। পানির অভাবে অর্ধেক ধানে চিটা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। বোরো চাষাবাদ করে এবার বড় ধরনের লোকসান গুণতে হচ্ছে।
মৌলভীবাজার কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কাজী লুৎফুল বারী জানান, খরার কারণে কিছু কিছু এলাকায় জমিতে ধানে চিটা ধরেছে, এটা আমাদের চোখে পড়েছে। তবে অন্যান্য জাতের ধানের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। এগুলো দিয়ে ঘাটতি পুষানো সম্ভব।