প্রত্যাশিত ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে স্বস্তি ফিরে পেয়েছে লাল সবুজের পতাকার ছায়াতলে বসবাসরত সকলে৷ মানুষ এখন মন খুলে কথা বলতে পারছে। বিপ্লবের পর মানুষের আনন্দের কান্না প্রমাণ করে কোন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে সময় কেটেছে। ফ্যাসিবাদ কায়েম করে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করেছিল আওয়ামী লীগ। সেই ভয় কি পরিমাণে ছিল তা বিপ্লব পরবর্তী মানুষের উল্লাস ইঙ্গিত দেয়। পিঞ্জিরা থেকে মুক্তি পেয়ে পাখি যেমন উৎফুল্ল হয়ে সঙ্গে সঙ্গে উড়াল দেয়, বাংলাদেশের জনগণও এইমুহূর্তে তাঁর নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে। এই নীড় সম্প্রীতির, এই নীড় স্বস্তির।
দীর্ঘ ১৬টি বছর স্বৈরশাসক পুরো দেশের চিত্র পাল্টে দিয়েছে৷ গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত ভোট, সেই ভোটাধিকার প্রয়োগের সংস্কৃতি থেকে মানুষকে দূরে রেখেছে৷ একনায়কতন্ত্র চালুর মাধ্যমে গুম-খুন, রাহাজানি, দূর্নীতি ও সর্বোপরি সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়েছে। আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি এমনকি পরিবারের মধ্যে অকল্পনীয় বিভাজন তৈরি করেছে ফ্যাসিস্ট শাসক। দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে স্বামী-স্ত্রীর তালাকেরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল আওয়ামী দুঃশাসন ( বিএনপি করায় স্বামীকে তালাক, থানায় অভিযোগ- দৈনিক ইত্তেফাক ২৬ আগস্ট ২০২৩) । স্কুল-কলেজে সহপাঠীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে রেখেছিল বিভাজনের নীতি। রাজনৈতিক সচেতন মহলে এসব নিয়ে দেখা দিয়েছিল চরম হতাশা। দেশের এমন কোনো সেক্টর পাওয়া যাবে না যেখানে অপরাজনীতির কালো থাবা মারেনি শেখ হাসিনার দল৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সামাজিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মস্থল কিছুই ছাড় দেয়নি ফ্যাসিস্ট সরকার। সবকিছুই স্বৈরাচারী কায়দায় পরিচালিত হতো৷ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার মানসিকতা যেন সমাজ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল৷ যেকোনো দাবি আদায়ের আন্দোলনকে সরকার বিরোধী আন্দোলন বলে চালিয়ে দেওয়া হতো৷ যারা যৌক্তিক দাবি আদায় বা প্রয়োজনে প্রতিবাদ করার জন্য রাস্তায় নামতেন, গণমাধ্যমে লিখতেন, কথা বলতেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতেন সবাইকে রাজাকার বানিয়ে দেওয়া হতো৷ সাইবার সিকিউরিটি আইনে অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। কেউ কেউ গুম-খুন ও নির্যাতনের ভয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হতে হয়েছিল৷
হাজারো ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে। বিপ্লবী মানুষের রোষানলে পড়ে দেশ থেকে শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এখনই সময় দেশকে মনের মাধুরি দিয়ে সাজানোর। আবেগ, অনুভূতি ও নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে সাজাতে হলে শুরুতেই সামাজিক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। বন্ধু বন্ধুর সঙ্গে চলাফেরা করতে পারতো না কেবল রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে। রাজনৈতিক পদ হারানোর ভয়ে বন্ধুর পরিচয় পর্যন্ত দেওয়া অপরাধ ছিল৷ বিয়েতে দাওয়াত দেওয়া কিংবা মৃত মানুষের জানাজায়ও রাজনৈতিক বিবেচনায় লোকসমাগম হতেও দেখা গিয়েছে। এমনও হয়েছে অসুস্থ রোগীকে দেখতে গেলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় দেখা মিলতো। আওয়ামী পরিবারের কেউ অন্য দলের রাজনীতির সঙ্গে আত্মীয়তা কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলে পদ হারাতে হতো৷ দলীয় বিবেচনায় চাকুরী ছিল একদম স্বাভাবিক একটি বিষয়। দলীয় পদ পদবি যাচাই-বাছাই করার পাশাপাশি মা-বাবা, ভাই-বোন এমনকি মামা-খালোর রাজনৈতিক মতাদর্শ তদন্ত করে চাকুরি নিশ্চিত করার সংস্কৃতি ছিল৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা একদম স্বাভাবিক ছিল। শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফল নির্ধারণের বহু অভিযোগ রয়েছে। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এমন অভিযোগে অসংখ্য শিক্ষককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে শিক্ষার্থীরা৷
ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে রাজনৈতিক কারণে৷ পারিবারিক খাবার টেবিলের চিত্র ছিল খুবই ভয়ানক। ভালোবাসাহীন এক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে কেটেছে ১৬টি বছর। এ-থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের সামাজিক সম্প্রীতির সংস্কৃতি। নির্বাচনে ভিন্নমতের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলে এলাকা ছাড়া, ঘর ছাড়া বা সমাজ ছাড়া করার ঘৃণিত কর্মকাণ্ড জাতি নীরবে দেখেছে৷
ভিন্নমতাবলম্বী হলেই ভিন্ন চোখে দেখা কিংবা মামলা দিয়ে জীবন নষ্ট করে দেওয়ার অপসংস্কৃতি থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে৷ জনগণের ইচ্ছের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে৷ চায়ের আড্ডায় নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করা হোক৷ ভিন্নমতাবলম্বিদের তুচ্ছতাচ্ছিল্যের পরিবর্তে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতি গঠনের আলোচনা হোক৷ অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনার এখনই সময়৷ কেবল রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কারো বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার স্বৈরনীতির কবর রচনা করে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গঠনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে৷
অন্তবর্তীকালীন সরকার মূলত বিপ্লবের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। এই সরকারের মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে হলে পুরনো সকল কিছুকে ডিলিট দিয়ে নতুন ভার্শন চালুর দাবি রাখে৷ এক্ষেত্রে সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সম্প্রতির বিকল্প নেই৷ ভীতিকর পরিবেশের পরিসমাপ্তি করে রাজনৈতিক সহাবস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য আইনশৃঙ্খলায় ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। ধর্মীয় মূল্যবোধ, আইনের শাসন ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার সমাজকে সুন্দরভাবে সাজাতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। নতুন করে পারিবারিক বন্ধন, বৈষম্যহীন সমাজ, উন্নত অর্থনীতির বাংলাদেশ সর্বোপরি সম্প্রতির বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে৷ মনে রাখতে হবে সুন্দর পরিবেশ একসময় নাও থাকতে পারে৷ সময়কে কাজে লাগিয়ে দেশকে নতুন করে সংস্কারের জন্য দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপের আহ্বান রইলো৷
আব্দুল্লাহ আল শাহীন
প্রবাসী সাংবাদিক
সংযুক্ত আরব আমিরাত