দেশের স্বাস্থ্য খাত অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে বলে অভিযোগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট শরিকদের। এই জোটের মতে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের মুখোশ খুলে পড়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপরে দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক নয় বলেও মন্তব্য করেন জোটের নেতারা।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের সরে যাওয়াকে অনেকে ইতিবাচক উল্লেখ করলেও ১৪ দলের মতে, যেসব অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তিনি পদ ছেড়েছেন, সে জন্য তিনি একা দায়ী নন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ছাড়া ডিজির পক্ষে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। কাজেই এসব দুর্নীতি-অনিয়মের দায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না। নৈতিকতার জায়গা থেকে দায় নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সরে যাওয়া উচিত মন্তব্য করে ১৪ দলের নেতারা বলেছেন, শুধু ডালপালা ছেঁটে লাভ হবে না। গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের দুরাবস্থার চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১৪ দলের নেতারা স্বাস্থ্য খাতের সমন্বয়হীনতা ও দুর্নীতির বিষয়ে আগে থেকেই সরকারকে সতর্ক করে আসছে। শরিকদের কেউ কেউ জাতীয় সংসদেও স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুরাবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। তারা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় কমিটি করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে ১৪ দলের অভিযোগ— সরকার তাতে কোনও কর্ণপাত করেনি।
করোনা পরিস্থিতিতে নমুনা পরীক্ষা, সুরক্ষা সামগ্রীসহ ছোট-বড় সব ধরনের কেনাকাটা, পণ্য সরবরাহ না করেই টাকা তুলে নেওয়া ও নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহসহ একের পর এক দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এর জের ধরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। অধিদফতরের এক পরিচালককেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোভিডের শুরু থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে সমন্বয়হীনতা ও অনিয়মের কথা আমরা শুরু থেকে বলে আসছি, সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও ফেপে ফুলে উঠেছে।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটি মন্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে সাবেক মন্ত্রী মেনন বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি বড়াইয়ের ভাব এসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, উনারা নাকি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছেন। উনারা নাকি আমেরিকার চেয়েও ভালো করেছেন। উনি আমেরিকা দেখেন পাশের দেশ নেপাল দেখেন না, শ্রীলঙ্কা দেখেন না, ভিয়েতনাম দেখেন না। উনার নজর উঁচু। এজন্য ওপরের দিকে দেখেন।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালকের পদত্যাগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘শুধু ডালপালা ছেঁটে লাভ নেই। দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে। এর সঙ্গে আর কারও সংশ্লেষ থাকলে তাদেরও সরিয়ে দিতে হবে।’
যে ঘটনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজি চলে গেছেন, তার জন্য তিনি একা দায়ী নন উল্লেখ করে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘উনি তো নিজেই বলেছেন— যেটা করেছেন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে করেছেন। মন্ত্রণালয় তো তার বক্তব্য এখনও খণ্ডন করতে পারেনি। তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বা তিনি পদত্যাগ করেছেন এটা ভালো। কিন্তু দায়-দায়িত্ব যাদের নেওয়ার কথা, তারা যদি না নেন, তাহলে কিছু বলার নেই। আর নতুন করে টাস্কফোর্স গঠন করার কথা বলা হয়েছে। আমার তো মনে হচ্ছে, এটা যে লাউ সেই কদু হবে।’
স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটি কাজে একটি নৈতিক দায়িত্ব নেওয়ার বিষয় আছে। তিনি নেবেন কিনা সেটা তার সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তার নৈতিকতার বোধ না থাকলে তো কিছু করার নেই। তিনি হয়তো এখনও প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন আছেন সেজন্য থাকছেন।’
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘পুঁজিবাদী সমাজের বাই-প্রোডাক্ট হলে দুর্নীতি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে, আবার অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। স্বাস্থ্য খাতে দ্বিতীয় চিত্রটি দেখা যাচ্ছে। তবে এটা ঠিক প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন।’
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আমিও পালন করেছি। এক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা হলো— মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছাড়া অধিদফতর কোনও কাজ করতে পারে না। মন্ত্রণালয়ের সম্মতি ছাড়া অধিদফতরের কাজ করার কোনও ক্ষমতাই নেই। কাজেই এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এড়ানোর কোনও সুযোগ নেই।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যদি সুবিবেচনা করেন নিশ্চয়ই যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেবেন। প্রধানমন্ত্রীর ওপরে আমাদের শতভাগ আস্থা আছে, যখন যেটা প্রয়োজন তা তিনি করবেন।’
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘সর্বত্রই দুর্নীতিবাজরা অবারিত হয়ে ওঠেছে। মন্ত্রণালয় কিংবা মন্ত্রীকে এড়িয়ে ডিজির কোনও কিছু করার ক্ষমতা নেই। মন্ত্রীর সঙ্গে নেগোসিয়েশন ছাড়া এত কিছু হওয়া সম্ভব নয়। কাজেই আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ডিজিকে সরিয়ে দেওয়া হলো— কেন মন্ত্রীকে নয়। প্রধানমন্ত্রী কেন তাকে বরখাস্ত করছেন না?’
দুর্নীতির ক্ষেত্রে সরকারের ইমিউনিটি সিস্টেম ভেঙে পড়েছে বলে মন্তব্য করে আম্বিয়া আরও বলেন, ‘সরকারের ইন্টারনাল কোনও ইমিউন সিস্টেম নেই। দুর্নীতি এবং অনিয়মের প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ত্রাণ কাবিখার দুর্নীতি নিয়ে হাসানুল হক ইনু সংসদে বক্তব্য দেওয়ার পর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা তো সবারই জানা আছে। তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। কিন্তু তিনি তো মিথ্যা কথা বলেননি।’
তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন হচ্ছে এটা সত্য, কিন্তু উন্নয়নটা হচ্ছে লুণ্ঠনের জন্য।’
জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, ‘আমরা করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়হীনতা ও দুর্নীতি-অনিয়মের কথা বলে আসছি। দিন যত যাচ্ছে বিষয়টি ততই প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।’
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা দুর্নীতিতে ছেয়ে আছে। এ খাতে পদে পদে অব্যবস্থাপনা। এর থেকে স্বাস্থ্য খাতকে মুক্ত করতে হলে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।