১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সৌদি আরবে আছেন মোহাম্মদ জোবায়ের। শারীরিক অসুস্থতার কারণে দেশে ফিরতে ১৬ মার্চ রাতের ফ্লাইটের টিকিট কেটেছিলেন তিনি। কিন্তু তার ১২ ঘণ্টা আগেই সৌদি আরব আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় তার আর দেশে ফেরা হয়নি। একটি কফিশপে কাজ করতেন জোবায়ের, সৌদি আরবে লকডাউনের কারণে সেটি বন্ধ হওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তিনি। সংকটে পড়ে দেশ থেকে টাকা এনে জীবিকা নির্বাহ করছেন জোবায়ের। সম্প্রতি সৌদি আরবে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ফেরাতে দুটি বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সে ফ্লাইটের ন্যূনতম ভাড়া ৩০৩০ সৌদি রিয়াল, যা বাংলাদেশে ৬৮ হাজার ৬০০ টাকা প্রায়। আক্ষেপ করে মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, দেশে ফিরতে মার্চে ৯৫০ রিয়াল দিয়ে টিকিট কেটেছিলাম, বুঝলাম খালি এসে যাত্রী নেবে, সেজন্য ভাড়া দ্বিগুণ হলেও হবে ১৯০০ রিয়াল। কিন্তু তিন গুণ ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা থাকলে তো আমরা দেশে ফিরতাম না, এখানেই থেকে অপেক্ষা করতাম।
শুধু জোবায়েরই নয়, এমন সংকটে আছেন সৌদি আরবে কর্মহীন হাজারও প্রবাসী। কেউ কাজ হারিয়ে, কেউ অসুস্থ হয়ে, কেউ অবৈধ হয়ে পড়ায়, আবার অনেকেই প্রবাস জীবনের ইতি টেনে একেবারেই ফিরতে চান দেশে। সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশের ফ্লাইট চালু হলেই দেশে ফিরবেন তারা। বিশেষ ফ্লাইটের ঘোষণায় আশার আলো দেখলেও সেই ফ্লাইটের ভাড়া অন্ধকার করে দিয়েছে তাদের দেশে ফেরার পথ। আয়হীন এই প্রবাসীদের অনেকেই দেশে ফিরতে না পেরে জীবন বাঁচাতে দেশ থেকে টাকা এনে জীবন নির্বাহ করছেন। আর যারা সৌদি আরবে অবৈধভাবে এসেছেন কিংবা ভিসার মেয়াদ শেষে অবৈধ হয়ে পড়েছেন তাদের সংকট আরও বেশি। সৌদি পুলিশের হাতে আটক হওয়ার ভয়ে অনেকেই লুকিয়ে থাকছেন। অন্যদিকে দূতাবাসের সহযোগিতা ছাড়া তাদের দেশে ফেরাও সম্ভব না।
সৌদি আরবের তায়েফে থাকেন মোহাম্মদ জোবায়ের। নিজের কষ্টের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তাই মার্চেই দেশে ফিরতে টিকিট কেটেছিলাম, কিন্তু এমন কপাল খারাপ যেদিন আমার ফ্লাইট তার ১২ ঘণ্টা আগে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণা করে। জোবায়ের বলেন, দূতাবাসে কথা বলে কী করবো, তারপরও ফোন করেছিলাম, জানালাম আমি অসুস্থ দেশে ফিরতে চাই। দূতাবাসের যিনি ফোন ধরেছিলেন, তিনি আমাকে বললেন, ‘আমরা কী করবো।’ এই হচ্ছে বাংলাদেশের দূতাবাস। অথচ আমাদের আশেপাশে ভারত-পাকিস্তানের যারা সংকটে ছিলেন তাদের প্রতিনিয়ত দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যতদূর জানি, সৌদি আরব থেকে পাকিস্তানিরা ১৭শ’ রিয়ালে নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছে। আর জেদ্দা থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নিতে বিমানের ফ্লাইটের ভাড়া ধরা হয়েছে ভাড়া ৩০৩০ সৌদি রিয়াল। বেশির ভাগ শ্রমিক মাসে ৬০০ থেকে ৮০০ রিয়াল বেতনে কাজ করে, তাদের কাছে যদি ২৮০০ রিয়ালই থাকতো, তবে তাদের তো দেশে ফেরার দরকার ছিল না। বরং দেশে টাকা পাঠাতো।
দূতাবাস থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, আবেদন করার পর দূতাবাস থেকে ৭০ রিয়াল মূল্যমানের একটি শপিং কার্ড দেওয়া হয়েছে, যেটি দিয়ে নির্দিষ্ট শপিং মল থেকে খাদ্যদ্রব্য কেনা যাবে। কিন্তু শপিং মলে যেতে আসতে আমাকে ভাড়া দিতে হয়েছে ২০ রিয়াল। বাকি ৫০ রিয়ালে আর কী হয়? ৫ কেজি চাল কিনতেই তো শেষ হয়ে যায়।
সম্প্রতি সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ২০ জুন রিয়াদ থেকে ও ১ জুলাই জেদ্দা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুটি বিশেষ ফ্লাইট ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। রিয়াদ থেকে ঢাকা ফ্লাইটের ইকোনমিক ক্লাসের ভাড়া ধরা হয়েছে ২৮০০ সৌদি রিয়াল, বিজনেস ক্লাসের ভাড়া ৩৮০০ সৌদি রিয়াল। আর জেদ্দা থেকে ঢাকা ফ্লাইটের ইকোনমিক ক্লাসের ভাড়া ধরা হয়েছে ৩০৩০ সৌদি রিয়াল, বিজনেস ক্লাসের ভাড়া ৪০৩০ সৌদি রিয়াল। নিজ খরচে দেশে ফিরতে চাইলে প্রবাসীদের নিবন্ধন করতে বলা হয়েছে। এছাড়া এই ফ্লাইটে যেতে চাইলে ‘করোনায় আক্রান্ত নয়’ সৌদি কর্তৃপক্ষের ইস্যুকৃত সার্টিফিকেটও থাকতে হবে।
বগুড়ার সান্তাহারের মোহাম্মদ আব্দুল মালেক সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন গত ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখ। দালালের কথার লোভে পড়ে সৌদিতে গেলেও ভাগ্য তার বদলায়নি। প্রথমে একটি কোম্পানিতে কাজ পেলেও আকামা পাননি হাতে। যে টাকা দেশ থেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তা নিয়ে চলতে হয়েছে প্রথমে। কাজ করার ১ মাস বাদে বেতন চাইলে তাকে বলা হলো ৩ মাস পর বেতন দেওয়া হবে। আব্দুল মালেক সেই আশা ছেড়ে জেদ্দা থেকে রিয়াদে চলে আসেন। রিয়াদে একটি কোম্পানিতে কাজ পেলেও করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যায় কোম্পানিটি।
তিনি বলেন, ৪ মাস ধরে বেকার কোনও কাজ নেই, কোনও কাজ পাবো সেই আশাও দেখছি না। যেখানে বাড়িতে টাকা পাঠানোর জন্য বিদেশে এলাম, এখন উল্টো দেশ থেকে টাকা এনে খেতে হচ্ছে। পরিবারের পক্ষে তো আর প্রতিমাসে টাকা পাঠানো সম্ভব না, তাই দেশে ফিরে যেতে বলছে। কিন্তু দেশে ফিরবো কীভাবে, বিশেষ ফ্লাইটের ভাড়া দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। এখানে থাকবো সেই সামর্থ্যও নেই। যে পরিস্থিতি সরকার যদি আমাদের দেশে না নিয়ে যায় তাতে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।
একই পরিস্থিতিতে আছেন আরেক সৌদি প্রবাসী হৃদয় খান। তিনি বলেন, সৌদিতে আসার পর দুমাস বেকার ছিলাম। আমাকে মার্কেট ক্লিনারের চাকরির কথা বলা হয়েছিল, সৌদিতে আসার পর কাজ দেয় সোলার প্ল্যান্টে। আমি সেই সোলার প্ল্যান্টে ২ মাস কাজ করি। আমার বেতন ধরা হয় ৭০০ রিয়াল, কিন্তু দুই মাসের বেতন দেয়নি, একবার ভাবলাম দেশে ফিরে যাবো। কিন্তু সৌদিতে আমার এক বন্ধুর সহযোগিতায় নতুন কাজে ঢুকলাম, সেখানে ২ মাস কাজ করি। এক মাসের বেতন ২৬০০ রিয়াল পাই, আরেক মাসের বেতন দেয়নি। কিছু টাকা রেখে বাকি টাকা দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তিন মাস ধরে কোনও কাজ নেই। ২০০ রিয়াল বাসা ভাড়া দিতে হয়, মাসে খাওয়া খরচ আরও ২০০ থেকে ২৫০ রিয়াল। এত খরচ করার তো কোনও ব্যবস্থা নেই। শেষে ঈদের আগে দেশ থেকে ১ হাজার রিয়াল এনে এখন চলছি। এভাবে এখানে থাকা সম্ভব না, তাই দেশে ফিরে যেতে চাই।
সৌদি আরবের মদিনায় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি মুসা আব্দুল জলিল বলেন, সৌদিতে যারা অবৈধভাবে আছেন, তাদের আর এখানে থাকার ও কাজ করার সুযোগ নেই। ফলে তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে সৌদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা করে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। যারা দেশে ফিরে যেতে চান তাদের জন্য বিশেষ ফ্লাইটের ভাড়া অনেক বেশি। এত টাকা দিয়ে দেশে ফিরে যাওয়া কঠিন। বাংলাদেশ সরকার অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে ভর্তুকি দিচ্ছে, প্রবাসীদের ফেরার ক্ষেত্রেও সুযোগ নেওয়া উচিত।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন