সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাষিরা দেশে উৎপাদিত পাট পুরোটা বিক্রি করতে পারবেন কিনা—তা নিয়ে শঙ্কা ছিল। তবে তৃণমূলের চাষি ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাট বিক্রি নিয়ে কখনও তাদের ভাবতে হয়নি, এবারও ভাবতে হবে না। কারণ, উৎপাদিত পাটের মূল ক্রেতা বেসরকারি পাটকলগুলো। দেশে উৎপাদিত পাটের বড় অংশ তারা কিনে নেয়। এরপর যা বাকি থাকবে তা রফতানির সুযোগ তো আছেই।
পাটচাষের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, বন্যার কারণে এবার পাটের উচ্চতা কম, এতে উৎপাদন কমবে। তবে পাট ওঠা শুরু হয়ে গেছে এবং শুরুতেই যে দাম মিলছে তা আশান্বিত হওয়ার মতো। চাষিরা বলছেন, এবারের পাট সবেমাত্র উঠতে শুরু করেছে। প্রতি মণ সর্বোচ্চ দুই হাজার ২৫০ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এটি অন্যবারের তুলনায় ভালো দাম।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ৮ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে পাট এবং পাটজাতীয় (কেনাফ ও মেস্তা) ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। দেশে প্রতিবছর পাট উৎপাদনের পরিমাণ ৮০ লাখ থেকে ৮২ লাখ বেল (১৮২ দশমিক ২৫ কেজিতে এক বেল)। এ বছর বন্যায় জমি ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় আগেভাগে কেটে ফেলার কারণে পাটের উচ্চতা কমেছে, তবে মান ভালো হবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, এ বছর পাট জাগ দেওয়ার পানির অভাব হবে না। বেশি ও ভালো পানিতে পাট জাগ দিতে পারলে পাটের রঙ ভালো হয় বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
কার কী পরিমাণ পাট লাগে
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সারাদেশে ৮০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদন হয়। বন্যার কারণে এ বছর পাট উৎপাদন কিছুটা কমবে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭৩ লাখ ১৫ হাজার বেল। ওই বছর কাঁচা পাট রফতানি হয়েছে আট লাখ ২৫ হাজার বেল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কাঁচা পাট রফতানি হয়েছে চার লাখ ৭৫ হাজার বেল। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সূত্র বলছে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশই ছিল পাটের অবদান। বর্তমানে রফতানি খাতে পাটের অবদান ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। যদিও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কাঁচা পাট রফতানির পরিমাণ ছিল ১০ লাখ এক হাজার বেল।
বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন-বিজেএমএ’র চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দেশে পাটের বার্ষিক চাহিদা ৬৪ লাখ থেকে ৬৫ লাখ বেল। এর মধ্যে বেসরকারি পাটকলগুলোর বার্ষিক চাহিদা ৬০ লাখ বেল। এ বছর সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ থাকার কারণে তারা কোনও পাট কিনবে না, ফলে বাকি পাট বিদেশে রফতানির সুযোগ রয়েছে। যদিও এ বছর এর পরিমাণ খুবই কম হবে।’
কাঁচা পাট রফতানিতে বাধা নেই
২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ‘পাট আইন-২০১৭’ এর ধারা-১৩ মোতাবেক পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আন-কাট, বিটিআর এবং বিডব্লিউআর নামে তিন প্রকার কাঁচা পাটের রফতানি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। পরে ২০১৯ সালের ১২ জুন এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। ওই তিন ধরনের পাট হলো—আন-কাট বা আস্ত কাঁচা পাট, বিটিআর বা বাংলাদেশ তোষা রিজেকশন ও বিডব্লিউআর বা হোয়াইট রিজেকশন। জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট রফতানিতে কোনও বাধা নেই।
বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বিজেএমএ মনে করে, মোট কাঁচা পাটের দুই শতাংশের বেশি নয় আন-কাট, বিটিআর ও বিডব্লিউআর। অথচ এই তিন প্রকার পাটের রফতানি দেখানো হয় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। সাধারণত, কাঁচা শ্রেণিতে ছয় ধরনের পাট রফতানি হয়ে থাকে। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হওয়া তিন ধরনের পাটের রফতানির পরিমাণ কাগজে-কলমে মোট পাট রফতানির প্রায় ৬০ শতাংশ।
বাংলাদেশি পাটের বড় ক্রেতা হচ্ছে ভারত। কাঁচা পাট আকারে বছরে ১১ লাখ বেল রফতানির মধ্যে ৮ লাখ বেলই যায় ভারতে। এছাড়া পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশেও বাংলাদেশি কাঁচা পাট রফতানি হয়।
বিপাকে কৃষক নয় শ্রমিক
সরকারি পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তে পাট চাষিদের হয়তো দুর্ভোগে পড়তে হবে না, কিন্তু এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার শ্রমিক ও তাদের পরিবার। প্রায় ৭০ হাজার কর্মী কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে—সেটা রাষ্ট্রকেই ভাবতে হবে উল্লেখ করে শ্রমিক নেতা আকরামুল হক বলেন, ‘২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। তাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও যাবতীয় সুবিধার নিশ্চয়তা প্রদান করা সরকারের দায়িত্ব। সেই নিশ্চয়তা প্রদান না করে পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কিন্তু সেটা যখন হয়েই গেছে, এই শ্রমিকদের জীবন ধারনের ন্যূনতম পরিস্থিতি তৈরির দায়িত্বটুকুও রাষ্ট্রকে নিতে হবে।’
অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় বর্তমানে পাটের উৎপাদন ভালো উল্লেখ করে বস্ত্র পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর সিদ্দিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কৃষক এখন খুশি হয়ে পাটচাষ করছে। সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ থাকলেও কৃষকদের এবার পাট বিক্রিতে কোনও বেগ পেতে হবে না। কারণ বেসরকারি পাটকলগুলোতে তা বিক্রি হবে। এর বাইরে কাঁচা পাট রফতানির সুযোগও রয়েছে। বন্যার কারণে ফলনের পরিমাণ কম হলেও কৃষকরা ভালো দাম পাবে বলে জানান তিনি।