নির্বাচন কমিশন দেশের একশ সমস্যার মধ্যে একটি বলে মন্তব্য করেছেন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বীরবিক্রম। তিনি বলেন, যেখানে সারা শরীরে পচন ধরেছে, সেখানে একটি আঙুলের কথা ভেবে লাভ নেই।
শুধু নির্বাচন কমিশনের কথা চিন্তা করলে হবে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থায় যে পচন ধরেছে তার সংস্কার করতে হবে। সামগ্রিকভাবে দেশকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তবেই জনগণ তাদের ভোটের অধিকারসহ হারানো সম্মান ফিরে পাবে।
মহাখালী ডিওএইচএসের বাসায় মঙ্গলবার যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ এসব কথা বলেন। দীর্ঘ আলোচনায় তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ, নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে কথা বলেন।
একই সঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, চলমান রাজনৈতিক সংকটসহ নানা ইস্যু তুলে ধরেন। চলমান সংলাপ প্রসঙ্গে অলি আহমদ বলেন, রাষ্ট্রপতি ইসি গঠনে এর আগেও কয়েক দফা সংলাপ করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। আমার দৃষ্টিতে এ সংলাপ একটি লোক দেখানো চায়ের অনুষ্ঠান মাত্র। রাষ্ট্রপতি নিজেও জানেন, বঙ্গভবনের অভ্যন্তরে থাকা তিনটি মাজার জিয়ারত করা ছাড়া সাংবিধানিকভাবে তার আর তেমন কোনো ক্ষমতা নেই, কিছু করারও নেই। তিনি বলেন, আমরা আমন্ত্রণ পেয়েছি। যাব কি যাব না দলীয় ফোরামে আলোচনা করে ঠিক করব।
এ সময় স্মৃতিচারণ করে অলি আহমদ বলেন, স্বীকার করতে হয়-১৯৯১ সালের সংবিধান সংশোধনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমরা ৪-৫ জন সিনিয়র মন্ত্রী বৈঠক করেছিলাম।
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান, আইন-বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ এবং আমি নিজে।
সংবিধানের সংশোধনীর বিষয়ে আমি তখন মুখ্য ভূমিকা পালন করেছি। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত করা হয়। অনভিজ্ঞতার কারণে দেশ ও দেশের মানুষের এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে প্রধানমন্ত্রীর পদটিকে একটি স্বৈরাচারী পদ হিসাবে রূপান্তরিত করি।
এর মধ্য দিয়ে আমি নিজেও দেশের ক্ষতি করেছি। উচিত ছিল, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রেখে সংবিধান সংশোধন করা।
তিনি বলেন, আগামীতে জাতীয় সরকার গঠন করে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা হবে। তা না হলে সংকট থেকেই যাবে। এ ছাড়া সংবিধানের অনেক মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন, সেগুলোও সংশোধন করা হবে।
কারণ, একটি বিষয় ইতোমধ্যে সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে- বাকশালী সংবিধান দিয়ে এদেশে আর যাই হোক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।
নির্বাচনি ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবি জানিয়ে সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, নির্বাচন পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপ ঢেলে সাজানো না পর্যন্ত ভোটের নামে অপকর্ম থেকে দেশ কখনোই আর বের হতে পারবে না।
সরকারের এবং সাংবিধানিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক না করে কোনো নির্বাচন ফলপ্রসূ হবে না। যেমন হৃৎপিণ্ড নষ্ট হলে বাতের ওষুধ দিলে কাজ হয় না, হৃৎপিণ্ডেরই চিকিৎসা করতে হবে।
সব প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাগুলোকে নতুন রূপে সাজাতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যারা সরকারে থাকবেন তাদের জনগণের সেবক হিসাবে নিজেকে মেনে নিতে হবে। ভোটের সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার করে জনগণের অধিকার জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।
সাবেক এ মন্ত্রী শাসক দল আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাকে আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
অনেকে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছে, দলীয় রোবটের মতো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তারা যে জনগণের বন্ধু এবং জনগণের সেবক একথাগুলো ভুলে গেছে। সর্বত্র শুধু আওয়ামী লীগ ও প্রধানন্ত্রীকে তুষ্ট করার কাজেই সবাই ব্যস্ত।
ভাবখানা এমন, যেন দেশের এবং জনগণের জন্য তাদের কিছু করার মনমানসিকতা নেই। অলি আহমদ আরও বলেন, এককথায় বলতে গেলে আওয়ামী লীগের লোক ব্যতীত অবশিষ্ট জনগণ একটি বৃহত্তর কারাগারে বসবাস করছে।
গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বলে দেশে এখন আর কিছু নেই। সরকারি দল এখন আর নিজেদের জনগণের সেবক হিসাবে মনে করে না। করলে সমাজের এত অধঃপতন হতো না। সুশাসন এবং ন্যায়বিচার বিলুপ্ত হতো না।
বর্তমানে যেভাবে দেশ চলছে এই অবস্থায় জনগণ আর কখনো ভোট দিতে পারবে না। দিবালোকে নির্বাচন হবে না। নিশি রাতে সরকারি ক্যাডার এবং আওয়ামী ক্যাডার সম্মিলিতভাবে ভোটের কাজ সম্পন্ন করবে। জনগণ নিজ দেশে অপমানিত, অত্যাচারিত এবং নির্যাতনের শিকার হবেন। আমার বিশ্বাস, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে জনগণই এগিয়ে আসবে।