রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদ সম্পূণরূপে নির্মূলের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ-প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরো ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিকেলে জাতীয় সংসদে বছরের প্রথম অধিবেশনে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি এ আহ্বান জানান। রীতি অনুযায়ী জাতীয় সংসদে বছরের প্রথম অধিবেশনেই ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপ্রধান দেশের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে মুক্তিযুদ্ধেও চেতনা আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, আত্মমর্যাদাশীল ‘সোনার বাংলা’ গঠনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার তাগিদ দেন।
রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের উন্নয়ন ও সাফল্য তুলে ধরেন।
রাষ্ট্রপতি হামিদ মেট্রোরেল চালু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল এবং নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মানসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, করোনা মোকাবিলা, বাস্তুুচ্যূত রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য প্রদান এবং জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরীতা নয়’-এ নীতির কথা উল্লেখ করেন রাষ্ট্রপতি।
তিনি বলেন, এর ওপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন গতিশীল এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারকরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শ্রমবাজার সম্প্রসারণে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বাস্তুচ্যূত রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
চলমান বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, সমগ্র বিশ্বই পার করছে এক কঠিন সময়।
তিনি বলেন, করোনা অতিমারি আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করে অর্থনীতির গতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হলেও রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ চলমান এই অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করেছে।
রাষ্ট্রপতি জানান, তারপরও ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ লক্ষ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রপতি সংসদকে জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক দুই-পাঁচ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় পূর্ববর্তী অর্থবছর থেকে ২৩৩ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
‘পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক চার-চার বিলিয়ন ডলারে,’ তিনি যুক্ত করেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বস্ত্র ও পাট খাতের অবদান গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে ১ দশমিক এক-তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং তৈরি পোশাকখাত থেকে ৪২ দশমিক ছয়-এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে।
আবদুল হামিদ বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত রয়েছে এবং বর্তমানে দেশে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক এক-চার লক্ষ মেট্রিক টন, যা সন্তোষজনক।
২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ৬০ বছরের উর্ধ্বে দেশের সকল নাগরিকের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, রাষ্ট্রপতি জানান।
রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, সরকারের যুগোপযোগী ও নারীবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণের ফলে বাংলার নারীরা দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রসঙ্গ টেনে রাষ্ট্রপতি বলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের নিট ভর্তি হার ৯০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৯৭ দশমিক চার-দুই শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ‘ঝরে পড়ার হার’ ৪৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৪ দশমিক এক-পাঁচ শতাংশে নেমে এসেছে।
সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৭ হাজার ৫৭৪ জন সহকারি শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যা স্বাধীনতার পর এক আদেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক, তিনি জানান।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে এবং ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’ উৎক্ষেপণের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে মাস্টার প্ল্যান, আইন, নীতিমালা ও স্ট্র্যাটেজি প্রণয়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
রাষ্ট্রপতি অত্যাধুনিক গণপরিবহন হিসাবে ৬টি মেট্রোরেল সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম উড়াল মেট্রো ট্রেন চালু হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান।
সরকারের কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬টি এমআরটি’র মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে।
নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী,সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেয়ার কথা বলেন আবদুল হামিদ।
শুরুতেই রাষ্ট্রপতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের শহীদ সদস্যদের। স্মরণ করেন, সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জাতীয় চার নেতা এবং গণতান্ত্রিক বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের।