তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: বর্ষার শেষেই শুরু হয় শরৎের রাজত্ব। শরৎ বেশ তাৎপর্য বহন করে প্রকৃতি প্রেমি আর ভ্রমণ পিপাষুদের পর্যটকদের কাছে। শরৎ ঘীরে রয়েছে কাশফুলের চমৎকার মিতালী। রোমাঞ্চে ভরা কাশফুলের নরম শুভ্রতা নিয়ে বরেণ্য কবিদের অসংখ্য কবিতার পঙ্ক্তিমালা মন ছুঁয়ে যাবে যে কারো। শরৎ নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নির্মেলেন্দু গুণসহ বিখ্যাত কবিরা। শরৎ মানেই নীল আকাশের নিচে ডানা মেলা পরীর মতো সাদা সাদা কাশফুল। আবহমানকাল থেকে শরৎে জেগে উঠা কাশফুল এখন অনেক নদীতীরে কিংবা পাহাড়ী উঁচু টিলাসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার পাহাড়-প্রকৃতিতে কাশফুলের দেখা মেলা কল্পনাতীত।
বর্তমানে জেলার পর্যটন উপজেলা শ্রীমঙ্গলের বেশ কয়েকটি চা বাগান কিংবা চা বাগানের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়ার পাড়ে জেগে উঠা চরে সারিবদ্ধ কাশফুলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পর্যটন এলাকা হওয়ায় এসব কাশফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকদের জটলা লেগেই থাকে। গণমাধ্যমের কল্যানে ওই এলাকার কাশফুলের সৌন্দর্যের বার্তাও পৌঁছে গেছে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটকের কাছে। তবে এবার মৌলভীবাজারের মনুনদীর তীর ঘেঁষে জেগে উঠা বালুচরে দেখা মিলেছে সাদা কাশফুলের অভয়ারণ্য। যদিও লোকচক্ষুর আড়ালে হওয়ায় এখানকার কাশবন নিয়ে মাতামাতি খুব একটা নেই। সাধারণত নদীর তীর, পাহাড় কিংবা গ্রামের উঁচু জায়গায় কাশবনের দেখা মেলে বেশি। তবে নদীর তীরেই কাশফুল বেশি জন্মাতে দেখা যায়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কনকপুর ইউনিয়নের ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে মনুনদীর ঢেউপাশা খেয়াঘাটের বিশাল এলাকাজুড়ে জেগে উঠা চরে সাদা কাশফুলের সারি। মনুনদীর বাঁধের উপর বন আর গাছের ছায়ায় অনেকটা আড়ালে পরে যাওয়ায় সাধারণত কাশফুল মূল সড়ক থেকে অনেকটা দেখা যায় না। কিন্তু প্রকৃতি প্রেমীদের চোখ ফাঁকি দেয়া সম্ভব না যে, তা এখানকার স্থানীয় কয়েকজন যুবকের সাথে কথা বলে জানা গেছে। বছর দু’য়েক আগেও এই এলাকার জেগে উঠা বালুচরে সাদা কাশফুলের নরম স্নিগ্ধতা উপভোগ করতে ছুটে আসতেন ভ্রমণ পিপাষু প্রকৃতি প্রেমীরা। প্রতিদিন ২থেকে ৩শ লোক নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ সড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে একনজর কাশফুল দেখতে ছুটে আসতেন এখানে। এখানকার জেগে উঠা কাশবনের দূরত্ব মূল সড়ক থেকে খুব একটা বেশি নয়। সড়ক থেকে মনুর বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে চোখ মেললেই দেখা দিবে নীল আকাশের নীচে হাতছানি দিচ্ছে অসংখ্য সাদা কাশফুলের লম্বা সারি বদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে আছে নিজ ভঙিমায়। তবে এখানে কাশফুলের অভয়ারণ্য হলেও আগের মতো আর লোকজনের আনাগুনা খুব একটা নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কারন হিসেবে তারা জানান, সংরক্ষণের অভাব। অতিরিক্ত কাশফুল হওয়ায় বেশ কিছু কাশফুল কেটে ফেলা হয়েছে কিংবা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু কাশফুল নয়, গাছপালা আর সবুজের সমারোহ থাকায় আশপাশের পরিবেশও বেশ নির্মল ও পরিপাটি। জায়গাটিকে পরিবেশবান্ধব ও একান্তে সময় কাটানোর উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উদ্যেগ নিয়েছেন বলে জানা গেছে। ওই সংগঠনটি তাদের নিজস্ব অর্থায়নে বাঁধের উপর কিছুটা দূর দূর স্টিলের তৈরি ব্রেঞ্চ বসিয়েছেন। এতকিছুর পরও যথাযত উদ্যেগ না থাকায় এখানকার পরিবশে-প্রকৃতি ও কাশফুলের অপার সৌন্দর্য দেখতে আগের মতো লোকজন খুব একটা আসেন না বলে জানা যায়।
এদিকে সবুজে ঘেরা পাহাড়-প্রকৃতিসহ পর্যটনের অপার সম্ভাবনা থাকলেও প্রবাসী আধ্যুসিত মৌলভীবাজার জেলা সদরে দু একটি রিসোর্ট ছাড়া পর্যটন কেন্দ্রিক অবকাটামো এখনো তেমন একটা গড়ে উঠেনি। ব্যক্তি উদ্যেগে সদর উপজেলার কনকপুরে গড়ে উঠেছে দুবাই ফান সিটি নামক ছোট্র পরিসরে একটি মাত্র শিশুদের পার্ক। মনুতীরের কাশফুলের সামান্য দূরত্বে যার অবস্থান। যা বদলে দিতে পারে এই এলাকার পর্যটন সম্ভাবনার সমূহ চিত্র।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও দূর্লভপুর গ্রামের বাসিন্দা সমাজকর্মী সঞ্জীব দে বলেন, এই জায়গায় একটা সময় প্রচুর কাশফুল ছিল,বিকেল বেলা ঘুরতে আসা মানুষের ভিড় লেগে থাকত। এখন অযত্নে আর অবহেলার কারনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অবশিষ্ট কাশফুল। তবে যথাযত কর্তৃপক্ষ নজর দিলে সংরক্ষণ করা সম্ভব। তিনি বলেন, এখানকার প্রকৃতি বেশ বৈচিত্রময়,শুধু কাশফুল নয়,আশপাশের মনজুড়ানো দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে পর্যটক সম্ভানা হাতছানি দিচ্ছে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাবরিনা রহমান (বাঁধন) বলেন, এখানকার কাশবন যদি সরকারী খাস জমির উপর হয় তাহলে এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর ব্যক্তিগত ল্যান্ডের উপর যদি হয় তাহলে তো আর কিছু করার নেই। আমি সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখব। তিনি আরো বলেন, মৌলভীবাজারের প্রতিটি ইউনিয়ন কেন্দ্রিক সরকারি খাস ভুমি পাওয়া গেলে একটি করে পার্ক গড়ে তোলার উদ্যেগ নেয়া হবে। যাতে ওই এলাকার লোকজন অবসরে বিনোদনের সুযোগ পান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়কারী ও নাট্য ব্যক্তিত্ব আ.স ম সালেহ সুহেল বলেন, শরৎকালীন বিশেষ সময়ে সাধারণত কাশফুল ফুটে,এটি একটি বিশেষ ফুল। বর্তমানে মনুনদীর তীরে অনেক জায়গায় কাশফুলে দেখা মিললেও সংরক্ষণের অভাবে কাশফুল হারিয়ে যাচ্ছে। নদী কেন্দ্রিক জেগে উঠা কাশবন আগামী প্রজন্ম যাতে দেখতে পারে তার যথাযত সংরক্ষণের জন্য উপজেলা প্রশাসনের তদারকির পাশাপাশি বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন বলে মনে করি।