তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ি ও বড়লেখা বিস্তৃর্ণ এলাকা স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় অবর্ণনীয় দূর্ভোগে পরেছেন প্রায় দু’লাখ মানুষ। চারিদিকে পানি থাকায় প্রচন্ড রৌদ্র আর ভেপসা গরমে জনজীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠেছে। দিনের বেলা রোদে পানি কিছুটা কমলেও প্রতিরাতের বৃষ্টিতে আবারও বানের পানি বেড়ে আগের অবস্থায় চলে আসছে। বানভাসী মানুষের দূর্ভোগ যেন পিছু ছাড়ছে না লাখ লাখ মানুষের এ দূর্ভোগ যেন এখন নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে পড়েছে।
যারা আশ্রয় শিবিরে ওঠেছেন তাদের ঈদের দিনটি কেটেছে অন্যের সাহায্য আর দান নিয়ে। দিয়েছেন প্রশাসন আর বিত্তবান লোকের দেয়া কোরবানী গোস্ত ও ত্রাণ সহায়তা নিয়ে এবারের ঈদ কাটাতে হয়েছে। বন্যার পানি একটু কমলে আশার আলো জাগে বাড়ি ফেরার আশা নিয়ে কিন্তু পরদিন সকালেই সেই আশায় গুড়ে বালি হয়ে যাচ্ছে। কখন পানি নামবে আর কবে বাড়ি ফিরবেন এই আশা-দুরাশায় দিন গুনতে হচ্ছে বানভাসী মানুষগুলোর।
মঙ্গলবার (১২ জুলাই) সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় বন্যা দূর্গত কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের কেন্দ্রবিন্দু সকল সরকারি দপ্তরের নিচতলা, টিটিডিসি এলাকা, উত্তর মাগুরা এলাকা, মহিলা কলেজ, উত্তর কুলাউড়া এলাকা সহ গোটা উপজেলার বিস্তৃণৃ এলাকায় প্রায় ২০-২৫ দিনের বেশি সময় ধরে পানিবন্দি হাজার পরিবার। স্মরণকালের এই ভয়াবহ বন্যায় এই দূর্ভোগ চরমে যা অসহনীয় হয়ে ওঠেছে। একই অবস্থা জুড়ি ও বড়লেখায় উপজেলা বিশাল এলাকার মানুষজন একই রকম দূর্ভোগে রয়েছেন।
কাদিপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামের শ্যামল দেব ও মনা দেব বলেন, বন্যার পানিতে তার বসত ঘরটি প্লাবিত হয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে । তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে অন্যের ঘরে প্রায় মাসখানেক বসবাস করছেন। পানি কোনদিন সরবে সেই চিন্তায় আছেন তবে বানের পানি নেমে গেলেও সেই ঘরে আর বসবাস করতে পারবেন না। কারণ মাটির ঘরটি ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পরেছে।
পাশের ছকাপন গ্রামের সোহেল মিয়া, বাদল বৈদ্য ও বাপন মালাকার বলেন, বানের পানিতে তাদের বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এভাবে পানিবন্দি থেকে পরিবারের বয়স্ক ও শিশুরা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত, হাতে পায়ে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। সাথে আছে তীব্র জ¦র, কাশি, ডায়রিয়া, আমাশয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। বাদল বৈদ্য ও সজল মল্লিক বলেন, বানের সময় যে সরকারি বেসরকারি সামান্য সহায়তা পেয়েছেন তা দিয়ে ক’দিন চলবে?
জুড়ি উপজেলার কলেজ রোডের সুনিল দে, দিলিপ দে বলেন, ২০দিনের উপর বন্যার পানিতে ঘরবন্দি আছি পরিবার নিয়ে। ক্ষুদ্র ব্যবসা করে পরিবার চালাতাম দোকানে পানি ওঠায় ব্যবসা বন্ধ। একদিন মাত্র সরকারি ত্রাণ পেয়েছি তাদিয়ে ১৪ জনের সংসার কয়দিন চলে? অন্যের কাছে ধারকর্জ করে পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’বেলা ডালভাত তুলে দিতে পারছিনা। নিজেকে পরিবারের কর্তা ভেবে লজ্জা লাগছে। এভাবে আর চলতে পারছিনা আমরা। বড়লেখা, জুড়ি ও কুলাউড়ার বিভিন্ন এলাকার বানভাসী লোকজন তীব্র ক্ষোভ নিয়ে জানান, হাকালুকির পানি ও ফানাই, আনফানাই ও জুড়িনদীর পানি, ছোট বড় ছড়ার পানি হাকালুকি হাওরের যে পথ দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদী দিয়ে দ্রুত নেমে যেত সেখানে অপরিকল্পিতভাবে বুড়িকোয়ারি নামক স্থানে বাঁধ দেয়ায় বন্যার পানি নামতে পারছেনা।
এছাড়া হাকালুকি হাওর এলাকায় বাঁধ ও ড্যাম তৈরি হওয়ায় বিগত কয়েক বছর ধরে এই দূর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা সঠিক কারণ চিহ্নিত করে দ্রুত কেন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না সেটাই জনক্ষোভের কারণ। এনিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রায় অর্ধ যুগ ধরে অনেক নিউজ করা হলেও কেন বিতর্কিত বাঁধটি এখনও অপসারণ করা হচ্ছে না তা এলাকাবাসীর বোধগম্য নয়।
তাঁরা বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে বানের পানি নামার জন্য রাস্তা কেটে দেয়ার নির্দেশ অনেক আগেই দিয়েছেন তবে কেন হাওরের পানি নামার বাঁধটি কাটা হচ্ছে না? প্রতিবছরই আমাদের দূর্ভোগ হচ্ছে অথচ কুশিয়ারা নদী ও সংযোগ খালগুলো ড্রেজিং করা হচ্ছে না কেন? মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আখরুজ্জামান বলেন, হাকালুকি হাওরে আমাদের কোন প্রকল্প চলমান নেই। এবার ১২২ বছরের ইতিহাসে সর্ব্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে। উজানের পানির সাথে প্রচুর পরিমান সেডিমেন্ট(বালি,পাথর, মাটি) আসে। হাওরের সাথে যুক্ত নদীগুলোর ও কুশিয়ারা নদীতে ড্রেজিং না করার ফলে নদীগুলোর তলদেশ অনেকটা ভরাট হওয়ায় বন্যার পানি দ্রুত নামতে পারছেনা। তবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে নিদের্শে বন্যা পরবর্তী সময়ে আমরা হাওরের সংযোগ নদীগুলো সমিক্ষা করে ড্রেজিং এর প্রকল্প নেব।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, জুড়ি, বড়লেখা ও কুলাউড়ার বন্যার পানি দ্রুত নেমে না যাওয়ার কারণ যে, কুশিয়ারা নদী ও হাওরের সংযোগস্থলে বুড়িকোয়ারি বাঁধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে কিনা তা আমি জানিনা। তবে বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদেরকে বলবো।