তিমির বনিক, মৌলভীবাজার থেকে: সরস্বতী বিদ্যা ও সংগীতের দেবী। শিক্ষা, সংগীত ও ললিতকলার সাথে যারা সম্পৃক্ত তারা সরস্বতীকে আরাধনা করেন। এছাড়াও জ্ঞান,বুদ্ধি ও বিচার বিবেচনা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীরা স্কুল- কলেজে উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে সরস্বতী দেবীর পূজা করেন। যেহেতু সরস্বতী পূজা ছাত্র- শিক্ষক,অভিভাবকসহ সর্ব সাধারণ এই পূজা করেন বিধায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি অন্যতম প্রধান উৎসব।
আজ মাঘ মাসের পঞ্চমী। শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামে পরিচিত। সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও করোনার তৃতীয় ঢেউ সুপার সাইক্লোনের ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। আর তাই সরকার ঘোষিত করোনার বিধিনিষেধ মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, পর্যাপ্ত পরিমাণে মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করে সারাদেশের মন্দির, স্কুল- কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যক্তিগতভাবে সকল সনাতন সম্প্রদায়ের লোক যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাব গম্ভীর্যের সাথে বাগদেবী সরস্বতীর পূজা উদযাপন করছেন। কিন্তু দেশের চলমান করোনার পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় নিয়ে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে যেকোনো ধরনের জনসমাগম এড়িয়ে চলার লক্ষ্যে ধর্মীয় আলোচনা মেলা,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বর্জন করা হয়েছে।
সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত। তবে প্রাচীন কালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতিমাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াতকলম রেখে পূজা করা হতো। শ্রী পঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট,দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত।গ্রাম অঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সরস্বতী প্রতিমা তৈরি করে পূজা করতেন। আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।
শ্রী পঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন হয়। সরস্বতী পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুযায়ী হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচারের প্রয়োজন হয়। তাহলো অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত- কলম ও যবের শিষ।পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ও পলাশ ফুলের প্রয়োজন হয়। লোকাচার অনুসারে ছাত্র- ছাত্রীরা পূজার পূর্বে কুল খায় না।পূজার দিন কিছু লেখাও পড়া নিষিদ্ধ। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ন, দোয়াত- কলম,পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। এইদিন ছোটদের হাতেখড়ি দিয়ে শিক্ষা জীবন শুরু হয়। পূজা শেষে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে ছাত্র ছাত্রীদের দল বেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ,ওড়িশা ও নেপালে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যায়। শ্রী পঞ্চমীর দিন খুব ভোরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে ও সার্ব্বজনীন পূজামন্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতে খড়ি, ব্রাহ্মণ ভোজন ও পিতৃতর্পণ প্রথাও প্রচলিত। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সার্ব্বজনীন পূজা মন্ডপ গুলিতে আরতী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার শহরতলীর বিভিন্ন বিদ্যালয় ও পাড়া মহল্লার পূজা অর্চনা স্বাভাবিক নিয়মে সরকারী বিধিনিষেধ মেনে চলছে পূজা অনুষ্ঠান।
উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকা কবিতা দাস এর সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি জানান যদিও প্রত্যেক বছরের ন্যায় হয়নি করোনা সংক্রমনের জন্য উপস্থিতি কম এবং সকলে স্বাস্থ্য বিধি মেনে পূজা পরিচালনা করছি। অন্য আরেক মন্দিরে গিয়ে দেখা যায় বাকি বাংলো পুকুর পাড় পুজা মন্ডবে যথারীতি পুজা অর্চনা চলছে। শহরতলীর মাষ্টার পাড়া পূজা মন্ডবে সুন্দর পরিবেশনার মাধ্যমে প্রতিবছরের ন্যায় সরকারী বিধিনিষেধ মেনে সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
পূজার পরদিন পুনরায় পূজার পর চিড়ে ও দই মিশিয়ে দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করা হয়। এরপরে পূজা শেষ হয় এবং সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জ্জন দেওয়া হয়।