বাংলাদেশে ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় আহলে হাদিস অনুসারীদের একটি মসজিদসহ মাদ্রাসা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে মামলার তদন্ত শুরু করা হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে।
মামলায় ঘটনার ব্যাপারে স্থানীয় হেফাজতে ইসলাম এবং কওমী মাদ্রাসার সমর্থকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
মাদ্রাসাটির পরিচালক অভিযোগ করেছেন, কয়েকশ লোকের হামলা চালিয়ে তাদের মসজিদ মাদ্রাসা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। এখন তারা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।
স্থানীয় হেফাজতে ইসলামের নেতারা বলেছেন, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীকে মারধোর করার অভিযোগ ওঠায় উত্তেজিত লোকজন ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় কামদিয়া গ্রামে আহলে হাদিসের অনুসারীরা মাদ্রাসাটি চালু করেছিলেন এক বছর আগে।
পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এই মাদ্রাসা ছিল আবাসিক। ভিত পাকা এবং টিনের দু’টি বড় ঘরে ছাত্র ছাত্রীরা আবাসিক হিসাবে থেকে পড়াশোনা করতো। মাদ্রাসার ভিতরেই তাদের মসজিদ ছিল।
গত বুধবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে যখন কয়েকশ লোক হামলা চালায়, তখন মাদ্রাসায় দুই জন শিক্ষক এবং ৩৫জন শিশু শিক্ষার্থী ছিল।
মাদ্রাসাটির পরিচালক ইলিয়াস হোসেন জানিয়েছেন, শিক্ষক এবং শিশু শিক্ষার্থীরা কোনভাবে জঙ্গলে পালিয়ে তাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে। পরে প্রশাসনের সহায়তায় শিশুদের যার যার পারিবারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেছেন, কয়েকদিন ধরে মাইকিং এবং সমাবেশ করে উস্কানি দেয়ার পর হামলা করা হয়েছে।
“হেফাজত এবং কওমী মাদ্রাসার লোকজন হামলার আগের দিন এলাকায় আমাদের মাদ্রাসার বিরুদ্ধে মাইকিং করেছে।”
ইলিয়াস হোসেনের অভিযোগ হচ্ছে, “উস্কানিতে পাঁচ ছয়শ লোক আইসা হামলা কইরা আমাদের ঘর দরজা ভাইঙা তছনছ কইরা দিছে। মাটির সাথে মিশায়া ফালাইছে কোরআন, বুখারী মুসলিমসহ সমস্ত কিতাব। এখন আমাদের মৃত্যুর হুমকি দিতাছে। আমরা মামলা করছি। আমরা মামলা না তুললে আমাদের মারবে-এই বলে হুমকি দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, তাদের এলাকার ছাড়ার হুমকিও দেয়া হচ্ছে। তারা এলাকায় নিজেদের বিশ্বাস নিয়ে নিরাপদে থাকতে চান।
আহলে হাদিসের মাদ্রাসার পরিচালক ইলিয়াস হোসেন আরও অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় হেফাজতে ইসলাম এবং কওমী মাদ্রাসার সমর্থকরা অনেকদিন ধরে তাদের বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য তুলে ধরছে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে একটা উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি করা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা প্রশাসন দুই পক্ষকে নিয়ে গত মঙ্গলবার একটি বৈঠক করে। পরদিন বুধবার প্রশাসনের সাথে সকালেই দ্বিতীয় দফায় বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।
সে বৈঠকের জন্য দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা ইউএনও কার্যালয়ে হাজিরও হয়েছিলেন।
তবে আহলে হাদিসের অনুসারীদের বিরোধীরা একটি সমাবেশেরও আয়োজন করেছিলেন। এরই মাঝে মাদ্রাসায় হামলা হয়।
বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করেন সালথা উপজেলা হেফাজতে ইসলামের একজন নেতা মো: নিজাম উদ্দিন। তিনি বলেন, আহলে হাদিসের অনুসারীরা কওমী মাদ্রাসার একজন শিক্ষার্থীকে মারধর করার অভিযোগ ওঠায় সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল।
তিনি বলেছেন, “তথাকথিত আহলে হাদিসের পাঁচজন লোক ওখানে একটা আস্তানা করেছে। সেই আস্তানা বানায়া মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করার কাজ শুরু করছে। এইজন্য আমরা তাদের আগেই নিষেধ করছি। সেই নিষেধ তারা মানে নাই।আমরা প্রশাসনকে বলছি। প্রশাসন সবাইকে নিয়া মিটিং করেছে। কিন্তু তারা যখন শোনে নাই, তখন আমরা একটা সমাবেশের আয়োজন করি।”
সালথার হেফাজত নেতা মো: নিজাম উদ্দিন আরও বলেছেন, “আমরা সমাবেশের আয়োজন করি। কারণ আমরা চাপ সৃষ্টি করলে যাতে ওরা চলে যায় বা ঐ পথ থেকে ফিরে আসে। ঐ সমাবেশের জায়গায় যখন লোকজন আসতেছিল, তখন মাদ্রাসার কয়েকটা ছাত্র সমাবেশে যাইতেছিল। এই ছাত্রদের একজনকে আস্তানার লোকজন মারছে। এরপরে ওখানে যে সমস্ত জনগণ ছিল, তারা ক্ষিপ্ত হইয়া ওদের ঐ ঘরগুলা ভাইঙা দিছে।”
হামলার শিকার মাদ্রাসাটির কর্তৃপক্ষ ২৮জনের নাম দিয়ে মামলা করেছে। তবে পুলিশ বলেছে, হামলাকারিদের চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত শুরু করা হয়েছে।
সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসিব সরকার বলেছেন, আহলে হাদিসের অনুসারীদের মাদ্রাসা আবার চালুর কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেছেন, সব পক্ষের সাথে আলোচনা করে তারা সমাধানের চেষ্টা করবেন।
“এমুহুর্তে যেহেতু একটা থমথমে পরিস্থিতি আছে। সেজন্য আমরা তাদের বলেছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সবার সাথে আলোচনা করে একটা সিদ্দান্ত নেয়া হবে।”
এরআগেও বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের বিরোধ থেকে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি হয়েছিল।
গত বছরের শেষদিকে ভোলা জেলায় আহলে হাদিসের অনুসারীদের একটি মসজিদ ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল।
হেফাজতে ইসলামের ঘনিষ্ট এবং লেখক শরীফ মোহাম্মদ বলেছেন, সংঘাত সৃষ্টি করা বা হানাহানি ইসলাম সমর্তন করে না।
“অপর পক্ষের কোনো উপসনা কেন্দ্র, মসজিদ মাদ্রাসা ভেঙে ফেলা, দাঙ্গা হাঙ্গামা, আক্রমণ-এগুলো কোনো অবস্থাতেই ঠিক না। আমরা মনে করি,বাংলাদেশে ইসলামী জীবন যাপন করে বা ইসলামী চিন্তার বিভিন্ন স্কুল যেটাকে আমরা বলি স্কুল অব থটস ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু হানাহানির পর্যায়ে যাওয়া উচিত নয়” বলে তিনি মনে করেন।
শরীফ মোহাম্মদ বলেছেন, “গ্রাম পর্যায়ে যাদের ভিতরে শিক্ষার মাত্রাটাও নীচে এবং সহনশীলতা মাত্রাও পরীক্ষিত নয়, সেখানে এই বিরোধগুলো চূড়ান্ত রুপ ধারণ করে অনেক সময়। এটা ঠিক নয়।”
এদিকে ফরিদপুরের সালথা উপজেলার যে গ্রামে আহলে হাদিসের মাদ্রাসায় হামলা হয়ে, সেই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।