গাজীপুরের টঙ্গী সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক মো. রেজাউল করিম ও টঙ্গীর ‘মাদক সম্রাজ্ঞী’ সাঈদা বেগমের এক লাখ পিস ইয়াবার চালান সংক্রান্ত একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। এরপর থেকে তারা ভোল পাল্টিয়ে নতুন কৌশলে মাদক ব্যবসা চালু রেখেছেন।
ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর ওই ছাত্রলীগ নেতা সাঈদা বেগমকে ডিবির সঙ্গে ফাঁদ পেতে ওই ইয়াবার চালান ধরিয়ে দেওয়ার দাবি করলেও স্থানীয়রা বলছেন ভিন্ন কথা।
রাজনৈতিক অঙ্গনে ওই নেতা রেজাউল করিম নামে পরিচিত হলেও আন্ডারগ্রাউন্ডের মাদক ব্যবসায় তিনি ‘সাগর’ নামে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে স্থানীয় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ রয়েছে।
রেজাউল করিম একটি আনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘বাংলাদেশের সংবাদ টুয়েন্টি ফোর ডটকম’ এর প্রকাশক ও সম্পাদক। অভিযোগ রয়েছে রেজাউল সাংবাদিক পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দেদারসে মাদক ব্যবসা করে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি ফোনালাপ ফাসেঁর পর ছাত্ররাজনীতির অন্তরালে রেজাউলের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এতে এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে তোলপাড়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেজাউল করিমের ঘনিষ্ঠ এক ছাত্রলীগ নেতা এবং গাজীপুর ছাত্রলীগের একজন সংগঠক জানান, রেজাউল করিম তার মাদকের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে এখন কৌশল পাল্টিয়েছেন। এখন তার মাদকের চালান আসে বোন রোকসানার নামে। রোকসানা একই এলাকার ইউনাইটেড স্কুলের পাশে কার্টন রফিকের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। তারা জানায়, রেজাউল করিম মাদক থেকে তিন দফায় ব্যবসা করেন। যেমন পাইকার ক্রেতা, বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে।
ঘনিষ্ঠ সূত্রটি আরও জানায়, রেজাউলের নিয়ন্ত্রণে প্রায় দুই শতাধিক (ছেলে ও মেয়ে) খুচরা মাদক বিক্রেতা রয়েছে। তারা স্কুল কলেজের ড্রেস পড়ে নিরাপদে ইয়াবা বেচাকেনা করে থাকে।
গত ২২ এপ্রিল টঙ্গী পূর্ব থানাধীন হিমারদীঘি কেরানিটেক বস্তিতে মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়।
ওই ঘটনায় আহতদের মধ্যে তিন জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাদের দাবি ওই প্রদর্শিত অস্ত্রগুলো ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল করিমের এবং ওই অস্ত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি গ্রুপ তার (রেজাউলের) কাছে রাখতে দিয়েছিল। সম্প্রতি ওই গ্রুপের নেতা আইনশৃংখলা বাহিনীর ক্রসফায়রে নিহত হলে অস্ত্রগুলো রেজাউলের কাছেই রয়ে গেছে।
এসব বিষয়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, রেজাউল আগে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল শুনেছি। কিন্তু এখন মিডিয়ার মাধ্যমে যা জানতে পারছি তাকে আমরা অবাক হচ্ছি। এখন তার এসব করা মোটেও উচিত না। তবে, তিনি রেজাউলের বোনের (রোকসানার) বিষয়টি এড়িয়ে যেতে বলেন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার আর্শিবাদে রেজাউল করিম টঙ্গী সরকারি কলেজের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। ওই পদ পেয়ে তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তিনি কব্জা করে নেন টঙ্গীর আন্ডারগ্রাউন্ডের মাদক নিয়ন্ত্রণ। কক্সবাজার ও টেকনাফ থেকে নিজের গাড়িতে সাংবাদিকের স্টিকার ব্যবহার করে মাদকের চালান আনেন অথবা বাহকের মাধ্যমে এনে পৌছে দেন টঙ্গীর বিভিন্ন কারবারির হাতে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের টঙ্গীর ব্যাংকের মাঠ ও কেরানীর টেক বস্তির মাদক সম্রাজ্ঞী এবং মাদকের ৮-১০টি মামলার এজহার নামীয় আসামী সাঈদা বেগম সম্প্রতি রেজাউলের একলাখ পিস ইয়াবাসহ ডিবির হাতে গ্রেফতার হন।
পরে পুলিশ সাঈদা এবং রেজাউলের কাছ থেকে নগদ ৪৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে মাত্র ১০ হাজার পিস ইয়াবা দিয়ে চালান দেয়। বর্তমানে সাঈদা বেগম জামিনে আছেন।
জামিনে বেরিয়ে আসার পর সাঈদা ও রেজাউলের মধ্যে দেড় ঘণ্টা ফোনালাপ হয়।
ওই ফোনালাপের আংশিক পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
সাঈদা: এক লাখ পিস মাল তুমি আনছ, এক কোটি টাকার জিনিস। যেই দিন তুমি মালডা আমার কাছে দিছ ওই দিন থেকেই বেডারা আমারে খোঁজতাছে। তুমি কও মালডি ফালাইয়া দিলে কি আমি বাঁচতাম?
রেজাউল : যদি কোনোভাবে মালগুলো (এক লাখ পিস ইয়াবা) আমার বাসা থেকে উদ্ধার হইত আমার ইজ্জত থাকত?
সাঈদা : ‘এক লাখ পিস মাল’ কোন গাড়ীতে করে নিছ এইডাও বেডারা যানে, কোন লোকেশন নিছ এইডাও জানে, তাইলে কও তারা আমারে রিমান্ডে নিয়া মারবে না আদর করবে?
সাঈদা বেগম : এই টাকা তো ডিবিরে খাওয়াইছি। আর তোমারে দিলাম।
রেজাউল করিম : ঢাকার ডিবিতো, এই জন্য কিছু করতে পারি নাই। টঙ্গী অথবা গাজীপুরের ডিবি না। তারা বাইরে থেকে আসছে। আল্লাহর কাছে আলহামদুলিল্লাহ বলেন, আল্লাহ আপনারে রাখছে।
সাঈদা : মালত তোমার আন্ডারে আসছে। এখন আমি জেলে থেকে অসুস্থ হয়ে গেছি। আমার কাছে কোন টাকা নাই। আমাকে কয় লাখ টাকা দিবা ?
রেজাউল করিম : দোয়া করেন যাতে পাশে থাকতে পারি।
সাঈদা : আমি তোমার ফাঁদে পাড়া না দিলে এত বড় মাইরডা খাইতাম না।
রেজাউল করিম : হ, এইডা আমি স্বীকার করি।
সাঈদা : দেইখ গুলি করে আমারে মাইরা ফেলাইও না। তোমারে আমার ভয়ই করে। তোমারে ৩০ লাখ টাকা না দিলে এখন আমি অন্তত চলতে পারতাম।
এর আগে ২০১০ সালে ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল করিম ৩৭ পিস ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেল খেটেছিলেন।
সাঈদার সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়ে রেজাউল কমির বলেন, ফেসবুকে আমার লাইভ আছে। ওই লাইভে সব কিছু আমি বিস্তারিত বলবো। ওই লাইভ দেখলে কেউই আর আমারে ফোন দিবে না। তার পরেও যদি কেউ মনে করে নিউজ করবে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি লাইভে সব স্বীকার কইরা দিমো। এতে আমার সঙ্গে এলাকাবাসী থাকবে, সাংবাদিকরা থাকবেন।
ইয়াবাসহ ধরা পড়ার কথা স্বীকার করে ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল বলেন, ওই মামলায় আমি খালাস পেয়েছি। পরে ২০ এপ্রিল ফেসবুক লাইভে এসে রেজাউল দাবি করেন, তিনি আগে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এখন আর করেন না।
এ বিষয়ে গাজীপুর সেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার লুৎফুল কবির বলেন, আমি আসার পর ১০ হাজার পিস ইয়ার এমন বড় চালান নিয়ে কোনো মামলা হয় নাই। তবে, এক লাখ পিস ইয়ার অডিও ভাইরাল হওয়ার বিষয়টি আমি শুনেছি। আমার একজন অফিসারকেতদন্ত করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছি। তদন্ত অনুযায়ী পরবর্তী অবশ্যই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।