ভিয়েতনামে কর্মসংস্থানের আশায় গিয়ে প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। প্রতি মাসে ৫০০ ডলারের বেশি আয়ের প্রতিশ্রুতি পেলেও দেশটিতে যাওয়ার পর কোনও কাজ পাচ্ছেন না তারা। উল্টো নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। প্রতারক চক্র অর্থপাচারে জোরপূর্বক ব্যবহার করছে তাদের। বাধ্য হয়ে অনেকেই দেশে ফিরে এসেছেন। অনেকে দেশে ফেরার জন্য সহযোগিতা চেয়ে সরকারের কাছে আকুতি জানাচ্ছেন। ভিয়েতনামে থাকা ও ভিয়েতনাম ফেরত একাধিক প্রবাসী এসব বর্ণনা দিয়েছেন।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় রিক্রুটিং এজেন্সির দালালরা ভিয়েতনামে উচ্চ বেতনে কাজ দেওয়ার কথা বলে প্রচারণা চালায়। ভালো প্রতিষ্ঠানে প্রতি মাসে ৫০০ ডলারেরও বেশি বেতনে কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে আগ্রহীদের ঢাকায় এজেন্সিগুলোর অফিসে এনে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। জনপ্রতি ৪ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নিয়ে প্রত্যেককে দেওয়া হয় বিএমইটি কার্ড (জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর ছাড়পত্র)। তবে তাদের ভিয়েতনামে পাঠানো হয় পর্যটক ভিসায়।
বাংলাদেশ থেকে কাজের আশায় ভিয়েতনামের উদ্দেশে বিমানে ওঠার সময় প্রত্যেকের সঙ্গে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার ডলার পর্যন্ত দেওয়া হয়। কেউ ডলার বহনে রাজি না হলে ফ্লাইট বাতিলের ভয় দেখানো হয়। ভিয়েতনামে পৌঁছানোর পর মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা বিমানবন্দরে তাদের গ্রহণ করে। তারপর ডলার ও পাসপোর্ট কেড়ে নেয়।
জানা গেছে, গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কমপক্ষে ১২০০ বাংলাদেশি কাজের আশায় ভিয়েতনামে গেছেন। তাদের প্রত্যেকেই কোনও না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। উচ্চ বেতনের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হলেও তাদের কাজ দেওয়া হচ্ছে না। ভিয়েতনামের হো চি মিন শহরে পাচারকারী চক্র নিজের নিয়ন্ত্রিত বাড়িতে বেশিরভাগ বাংলাদেশির জন্য থাকার ব্যবস্থা করে।
ভুক্তভোগী প্রবাসীদের অভিযোগ, উচ্চ বেতন ও ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজের কথা বলা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থায়ী কোনও কাজ পান না তারা। এক বা দুই সপ্তাহ একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করানোর পর নিয়ে যাওয়া হয় অন্যটিতে। তাছাড়া কাজ করলেও নিজের হাতে বেতন পান না। পাচারকারীদের ভাড়াবাড়িতে প্রবাসীদের আশ্রয় মিললেও থাকা-খাওয়ার খরচ বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়। কেউ প্রতিবাদ করলেই চলতে থাকে নির্যাতন। অনেককে নির্যাতন করে বাংলাদেশ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়।
এদিকে পাসপোর্ট না থাকায় পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন অনেক প্রবাসী। এমন পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচাতে ভিয়েতনামে বাংলাদেশ দূতাবাসে হাজির হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের মধ্যে রাজু আহমেদ ভিয়েতনাম থেকে দেশে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘উচ্চ বেতনের কথা বলা হলেও ভিয়েতনামে চিত্রটা করুণ। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। পাচারকারী চক্র বিমানবন্দর থেকে কেড়ে নেয় পাসপোর্ট। পুলিশের কাছে আটক হওয়ার ভয়ে কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পায় না।’
গত ৩ জুলাই ভিয়েতনাম থেকে ১১ বাংলাদেশি শূন্য হাতে দেশে ফিরে এসেছেন। তাদেরই একজন লালমনিরহাটের মো. কামাল। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে ভিয়েতনামে গিয়েছিলেন তিনি। তবে ভাগ্যবদল তো হয়নি, উল্টো বিপদ নেমে এসেছে তার জীবনে। ধার করে ৪ লাখ টাকা দিয়ে ভিয়েতনামে যাওয়ার সাত মাস পরই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে যায় কামালের। স্ত্রী, তিন সন্তান, বৃদ্ধ বাবা-মা আর এক বোনকে নিয়ে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে বেহাল দশা তার। ঋণের টাকা ফেরত চাইতে বাড়িতে এসে বসে থাকে পাওনাদাররা। তাদের কারণে একরকম পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কামাল। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে একবার সৌদি আরবে গিয়েছিলাম। সেখানে ধরা খেয়ে দেশে ফিরে আসি। এবার ভাবলাম ভিয়েতনামে গিয়ে ভাগ্য বদলাতে পারবো। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর দেখি ভিন্ন পরিস্থিতি, তাই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি।’
মো. কামাল জানান, আকিদুল ইসলাম নামের এক দালালের ফাঁদে পড়ে অ্যাডভান্স ওভারসিসের মাধ্যমে ভিয়েতনামে গিয়েছিলেন তিনি। বিএমইটি কার্ড থাকলেও তাকে পাঠানো হয় পর্যটক ভিসায়। পাচারকারীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য তার সঙ্গে ১ হাজার ডলার দেয় দালাল চক্র। এ বছরের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন কামাল। ভিয়েতনামে পৌঁছানোর পর তার কাছ থেকে ১ হাজার ডলার ও পাসপোর্ট রেখে দেওয়া হয়। সাইফুল ও আতিক নামের দুই ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে একটি বাড়িতে অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে ছিলেন তিনি। সাত মাস থাকলেও মাত্র একমাস কাজ করে ২০ হাজার টাকা আয় করতে পেরেছেন কামাল। সেই টাকা দিয়ে থাকা-খাওয়ার খরচও হয়নি। এ কারণে দেশ থেকে টাকা নিতে বাধ্য হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করে দেশে ফিরতে পেরেছেন তিনি।
মো. কামালের দাবি, ভিয়েতনামে কাজ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কোনও প্রবাসী প্রতিবাদ করলে তার ওপর চালানো হয় নির্যাতন। পাচারকারী চক্রের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মো. সুমন মিয়া নামের এক বাংলাদেশি। নির্মম নির্যাতনে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি।
সুমন মিয়া এখনও ভিয়েতনামেই আছেন। নির্মম নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন তিনি। তার বিবরণে, ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ভিয়েতনাম যান তিনি। সেখানে ফয়েজ, শরীফ, সাইফুল ও আতিক নামের মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা তাকে ক্রমাগত নির্যাতন করতে থাকে। একইসঙ্গে জিম্মি করে দেশে তার মায়ের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা আদায় করা হয়। এছাড়া ভিয়েতনামের এক নারীর কাছে সুমনকে বিক্রি করে দেয় পাচারকারী চক্রের সদস্য সাইফুল। তখন টাকার জন্য আবারও শুরু হয় নির্যাতন। তারপর ১৬০০ মার্কিন ডলার দিয়ে মুক্তি পান সুমন। তার কথায়, ‘আমাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। হাত-পা-বুকসহ কোথাও বাকি নেই যে মারেনি। তারা আমাকে মেরে মেরে দেশ থেকে টাকা নিতে বাধ্য করেছে। এখন আমি খেতে পারি না, খেলেই বমি হয়। বাঁচবো কিনা জানি না।’
কয়েকজন বাংলাদেশির সহায়তায় প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নেন সুমন। একমাস ধরে তাদের অধীনে আছেন। তবে বিমান টিকিটের টাকা না থাকায় দেশে ফেরা সম্ভব হচ্ছে না তার। বিশেষ ফ্লাইটের টিকিটের টাকা জোগাড় করতে না পারায় অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। তিনি বলেন, ‘দূতাবাস একটা জায়গায় আমাদের থাকার জায়গা দিয়েছে, কিন্তু খাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই এখানে। সবাইকে নিজের টাকায় খেতে হয়। আমার টাকা নেই, আমি অন্য মানুষের কাছ থেকে চেয়ে বা ধার করে কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। দূতাবাস জানিয়েছে, আমি যদি টিকিটের টাকা দেই তাহলে আমাকে দেশে ফেরার সুযোগ দেওয়া হবে। আমার বিএমইটি কার্ড না থাকায় দূতাবাস কোনও সাহায্য করতে পারবে না বলে দিয়েছে। আমি বলেছিলাম, দেশে ফিরে কাজ করে টাকা শোধ করবো। আমি তো বাংলাদেশের নাগরিক, আমি কি নিজের দেশেও ফিরে যেতে পারবো না?’
রাজু, কামাল কিংবা সুমনের মতো আর কোনও প্রবাসী বাংলাদেশি যেন প্রতারণার শিকার না হন সেজন্য প্রলোভন দেখানো রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
উৎসঃ বাংলা ট্রিবিউন