বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাওয়া নারী গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতন দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষায় বিদেশে যাওয়া নারী গৃহকর্মীদের সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা শেখা, রিক্রুটিং এজেন্সির পরিবর্তে সরকারিভাবে শ্রমিক পাঠানো, রিক্রুটিং লাইসেন্স ভাড়া দেওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ আট দফা সুপারিশ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিশেষভাবে সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী নিগ্রহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভাষার দুর্বলতাকে এর একটি অন্যতম কারণ বলা হয়ে থাকে। তাই গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে গমনেচ্ছু প্রত্যেক নারী কর্মীকে সংশ্লিষ্ট ভাষা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। যা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ভবনে কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। রিটার্নি গৃহকর্মীদের দ্বারা এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়া রিক্রুটিং এজেন্সি নয় বরং সীমিত আকারে দক্ষ নারী শ্রমিক সরাসরি সরকারিভাবে (জি টু জি পদ্ধতিতে) প্রেরণ করা যায়। বিদেশে স্পন্সরের অধীনে থাকাকালে যে কোন দুর্ঘটনা, মারধর, ধর্ষণ, হয়রানির যথাযথ বিচার চাওয়া এবং পাওয়ার অধিকার আদায়ে মামলা পরিচালনায় দূতাবাসের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা প্রয়োজন। অভিবাসী কর্মী গ্রহণকারী দেশসমূহের মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পর্যায়ক্রমে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করতে পারে বলে সুপারিশ করা হয়েছে।
বিচার পাওয়ার অধিকার আছে আবিরনের:
সৌদি আরবে নির্যাতিত ও নিহত গৃহকর্মী আবিরন হত্যার ঘটনায় তথ্যানুসন্ধান করে কমিশন সম্প্রতি এই সুপারিশমালা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
কমিশন বলছে, একজন অতিশয় দরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় নারী আবিরনের ক্ষেত্রে জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থাতে বার বার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। রিয়াদে যাওয়ার পর থেকেই সে নির্যাতিত হচ্ছিল। বাড়িতে কথা বললেই সে বলার চেষ্টা করত তাকে বাঁচতে দিবে না, দেশে ফেরত আনার আকুতি জানাত।
বিষয়টি রিক্রুটিং এজেন্সি এবং দালাল চক্র জানলেও তা চেপে রাখে এবং পরিবারকে হুমকি দিতে থাকে। দুই বছরের চুক্তি শেষ না হলে তাকে দেশে আনা যাবে না বলে আবিরনের পরিবারকে জানিয়ে দেয় ওই রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালাল চক্র।
অথচ এ ধরনের পরিস্থিতিতে হরহামেশা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয় নারী গৃহকর্মীদের ফেরত নিয়ে আসে। পরিবারের সচেতনতার অভাব এবং আর্থিক দুরবস্থা আবিরনের দুর্ভাগ্যকে আরো ঘনীভূত করেছে। এদেশের একজন নাগরিক হিসেবে তার ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
বিএমইটির সাবধানতা জনশক্তি রপ্তানি সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাবে:
২০১৭ সালে বৈধ কাগজপত্রের মাধ্যমে সৌদি আরবের রিয়াদে যান আবিরন। সেখানে গৃহকর্মীর কাজে থাকাকালে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হতে অবশেষে গৃহকর্ত্রী কর্তৃক খুন হন। তার লাশ দীর্ঘ সাত মাস রিয়াদের একটি হাসপাতালের মর্গে ছিলো। পরে ওয়েজ অনার্স ওয়েল ফেয়ার বোর্ডের নিকট আবেদনের প্রেক্ষিতে তার লাশ দেশে আনা হয়।
এ ঘটনা নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তথ্যানুসন্ধান করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের সদস্য ড. নমিতা হালদার এনডিসিকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব পেয়েই নমিতা হালদার নিহত আবিরনের পিতা-মাতা, বোন ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের পাশাপাশি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকসহ নানাজনের বক্তব্য গ্রহণ করেন।
ওই বক্তব্য ও দলিলাদি পর্যালোচনা করে মানবাধিকার কমিশনের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে রিক্রুটিং লাইসেন্স ভাড়া দেওয়ার অভিযোগে এয়ারওয়ে ইন্টারন্যাশনাল (আর এল-১০১৬) এর বিরুদ্ধে প্রচলিত শাস্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ আরোপ করার কথা বলা হয়েছে।
এই এজেন্সি দায়িত্ব হস্তান্তর করে নূর মোহাম্মদের কাছে। যার কোন রিক্রুটিং এজেন্সিই ছিলো না। যদিও ওই সময়ে এয়ারওয়ের লাইসেন্সটি মন্ত্রণালয় কর্তৃক লক ছিলো। প্রশ্ন জাগে লক লাইসেন্সে বিএমইটি বহির্গমন ছাড়পত্র দিলো কিভাবে?
এই দপ্তরের রক্ষণশীলতা ও সাবধানতা অনেক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারে। পারে এই সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। একইসঙ্গে কমিশন ওই ঘটনায় রিয়াদ দূতাবাসের মাধ্যমে আবিরনের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়, আটককৃত নির্যাতনকারীদের আদালতের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের লক্ষ্যে আইনি পদক্ষেপসহ প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা গ্রহণের সুপারিশ করেছে।
আবিরনের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ:
১. রিক্রুটিং লাইসেন্স ভাড়া দেওয়ার অভিযোগে এয়ারওয়ে ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে শাস্তি নিশ্চিত করা। আবিরনের জীবনের ক্ষতিপূরণ আদায় এবং প্রয়োজনে এয়ারওয়ে ইন্টারন্যাশনালের লাইসেন্স বাতিল করা।
২. নুর মোহাম্মদ ও ইকবাল নামে দুজন অন্যের লাইসেন্স ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তাদের পাঠানো কর্মীরা বিদেশে বিপদে পড়লেও কোনো ভ্রুক্ষেপ করেননি। চুক্তির বরখেলাপ করায় আবিরনের জীবনের ক্ষতিপূরণ আদায় করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে তাদেরকে নতুন লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে, যা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কারণ তারা অভিবাসী কর্মীদের প্রতি মোটেই সংবেদনশীল নন। এ ঘটনায় জড়িত পপুলার ট্রেড, ফাস্ট সার্ভিস এবং আইনুর এর রিক্রুটিং লাইসেন্স বাতিল করা প্রয়োজন।
৩. নিয়ম বহির্ভূতভাবে অন্য এজেন্সির কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র করায় ফাতেমা এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসের বিরুদ্ধে একই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
৪. দালাল মো. রবিউলের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
৫. ওয়েজ ওর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের অফিস সহকারী নিপুল চন্দ্র গাইনকে অবিলম্বে বরখাস্ত এবং তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।
৬. আবিরনের বেতন ভাতাসহ সব পাওনা আদায়ের জন্য রিয়াদ দূতাবাস সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৭.বিএমইটি ইমিগ্রেশনে আবিরনকে দুইবার রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য দায়ী কর্মচারীদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
Drop your comments: