মোঃ রাসেল ইসলাম,যশোর জেলা প্রতিনিধি: ভারতের বনগাঁর চাঁদাবাজিতে বন্ধ বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বানিজ্য। গত দুই মাসের অধিক সময় ধরে বেনাপোল বন্দরের সাথে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের সাথে দু‘দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গত ৩০ এপ্রিল দু’দেশের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে বাণিজ্য সচল করার নির্দেশনা দেওয়ার ফলে বাণিজ্য সচল করার জন্য দু’দেশের বন্দর ও কাস্টমসের মধ্যে কয়েক দফা সভা অনুষ্ঠিত হয় বেনাপোল চেকপোস্ট নো-ম্যান্সলান্ডে। তবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের অনীহায় কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনা ও বন্দর কর্তৃপক্ষের বৈঠকেও ফলপ্রসু কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
এদিকে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ থাকলেও বেনাপোল কাস্টম হাউস ও বন্দর সার্বক্ষণিক চালু রয়েছে। বন্ধের আগে থাকা বিভিন্ন পণ্য শুল্কায়ন ও খালাসও হচ্ছে। তবে ভারতের বনগাঁর আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাক পার্কিং সিন্ডিকেট দু’দেশের বাণিজ্য চালু করতে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে বেনাপোলের ব্যবসায়ীসহ বন্দর ব্যবহারকারীরা।
বেনাপোল বন্দরের ওপারে বনগাঁ পৌরসভায় রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। তারা দীর্ঘদিন এসব ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি করে পেট্রাপোল-বেনাপোল বন্দরকে জিম্মি করে রেখেছে। প্রতিনিয়ত বেনাপোল বন্দরে আসা পণ্যবাহী ট্রাক থেকে ব্যাপক হারে চাঁদা তুলে তারা বাংলাদেশের আমদানিকারকদের খরচের খাত বৃদ্ধি করছে বলে অভিযোগ করেছে আমদানি-রপ্তানিকারকরা। দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা চললেও ভারতীয় রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। এ সিন্ডিকেট ধীরে ধীরে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠায় এখন তারা কাউকে পাত্তা দিচ্ছে না। তাদের তৈরি কালিতলা পার্কিং এ ইচ্ছামত পণ্যবাহী ট্রাক রেখে টাকা আদায় করা হচ্ছে। তাদের মর্জির উপর ট্রাক পেট্রাপোল সরকারি সেন্ট্রাল পার্কিং এ পাঠানো হচ্ছে।
ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ৩০ এপ্রিল ও ২ মে বাংলাদেশে রপ্তানি করা ১৫ ট্রাক পচনশীল পণ্য খালাস করার বিনিময়ে আদায় করা টাকার ভাগ তৃণমূলের ও সিন্ডিকেটের সকল নেতা পায়নি বলে অচলাবস্থা তৈরি করা হয়েছে। অচলাবস্থা ধরে রাখতে সিন্ডিকেট বেনাপোলে শত শত করোনা রোগী মারা যাওয়ার ভুয়া গুজব বনগাঁতে রটিয়ে সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে।
পার্কিং সিন্ডিকেটের তৈরি সংকটজনিত অচলাবস্থায় বন্দর এলাকায় আটকা পড়েছে কয়েক হাজার ট্রাক। কালীতলাসহ বিভিন্ন পার্কিংয়ে আটকে পড়া অপেক্ষমাণ পণ্যের মধ্যে আরো রয়েছে অক্সিজেন, ওষুধ, প্যাকেজিং, গামেন্টস কারখানার কাঁচামাল, পাট, ধান, ভুট্টাবীজ, শিশুখাদ্য, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, মসলা, ফলমূল, শিল্পের কাঁচামাল। রোদ বৃষ্টি ঝড়ে খোলা আকাশের নিচে নষ্ট হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও পচনশীল পণ্য।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পোষাতে বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার অবাধে সাইডডোর ও এফসিএলসহ সব ধরনের রেলকার্গো বেনাপোল দিয়ে ভারত থেকে পণ্য আমদানি ও খালাসের অনুমতি চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) জরুরি চিঠি দিয়েছেন বলে কাস্টমসের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে। এর আগে কাস্টমস, স্থলবন্দর ও ব্যবসাবান্ধব রেলকার্গো চালুর জন্যে ত্রিপক্ষীয় সুপারিশ করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা চালু হলে একদিকে বনগাঁ সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে অন্যদিকে অল্প খরচে আমদানি পণ্য বাংলাদেশে আসবে বলে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা মনে করেন।
বেনাপোল বন্দর সূত্র জানায়, বাংলাদেশে শিল্প কারখানার জন্য ভারতীয় পণ্য, কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। আমদানিকারকরা চীন ও ইউরোপের পরিবর্তে ভারত থেকে পণ্য ও কাঁচামাল আনতে আগ্রহী। কিন্তু বিলম্ব ও হয়রানির কারণে তারা বেনাপোল বন্দর থেকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রকৃতি ভারতীয় পণ্যের চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে বেনাপোলে রেলকার্গো চালু অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ রেলকার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ট্রাকে বাহিত পণ্য বেনাপোল আসতে যেখানে ৫ থেকে ৭ দিন লাগে, সেখানে রেলকার্গোতে পৌঁছাতে লাগবে মাত্র ৩ ঘণ্টা। বাকি কয়েক ঘণ্টায় শুল্কায়ন ও খালাস কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে পণ্য চলে যাবে নির্দিস্ট আমদানিকারকের ঘরে। এ পরিস্থিতিতে পুরোদমে রেলকার্গো চালু হলে আমদানি দ্বিগুণ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ইতোধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ রেলওয়ে অনুমতি প্রদান করেছেন রেল কর্গোতে পণ্য আমদানির। তবে বনগাঁর পার্কিং সিন্ডিকেটের প্রভাবে বেনাপোলে রেলকার্গো আগমনের সিদ্ধান্তও বিলম্বিত হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি চালুর লক্ষে বারবার ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে নোম্যান্সল্যান্ডে দফায় দফায় মিটিং করলেও সেটা আসলে বাস্তবে রূপ নেয়নি। ফলে বেনাপোল কাস্টমস ও সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন একটা বিশেষ উদ্যোগে রেলওয়ের মাধ্যমে পণ্য আমদানি-রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এবং সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চিঠি পাঠান। সেই চিঠির আলোকে বাংলাদেশ রেলওয়ে সিদ্ধান্ত নেন বেনাপোল বন্দরের মাধ্যমে রেলযোগে পণ্য আমদানিতে তাদের কোনো বাধা নেই। তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) অনুমতি চেয়ে পত্র প্রেরণ করেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও নিয়েছেন এর ফলে আগামী সপ্তাহ থেকে রেলযোগে সমস্ত পণ্য আমদানি-রপ্তানি হবে বলে বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ মনে করেন।
এ বিষয়ে ইন্দো-বাংলা চেম্বার অফ কমার্স সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, বনগাঁ উত্তরের সাবেক এমএলএ গোপাল শেঠ ও বনগাঁ পৌরসভার মেয়র শংকর আঢ্য ডাকু পণ্য রপ্তানিতে বিরোধিতা করে কালীতলা পার্কিং থেকে পণ্য বোঝাই ট্রাক আসতে বাধা দিচ্ছে। এসব ট্রাকের প্রতিদিনের ভাড়ার টাকা ছাড়াও বনগাঁ পৌরসভা চাঁদা নিচ্ছে। প্রতিদিন ছোট গাড়ি ৫০ টাকা, ৬ চাকা ৮০ টাকা, ১০ চাকা ১২০ টাকা ও ট্রেলার ১৬০ টাকা হারে পার্কিং চার্জ আদায় করে থাকে। সিরিয়াল ভেঙে আগে গাড়ি বের করে দেয়ার জন্যও বড় অংকের টাকা নিচ্ছে।
বেনাপোল কাস্টম কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রকৃতি ভারতীয় পণ্যের চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে বেনাপোলে রেলকার্গো চালু এখন সময়ের দাবি। আমদানিকারকের সামনে মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিকল্প পণ্য, বিকল্প দেশ উন্মুক্ত। বহু আমাদানিকারক বেনাপোল থেকে চট্রগ্রাম, মোংলা ও অন্যান্য বন্দরে চলে গেছে। ৩৫ হাজার কোটি টাকা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য কিছু লোভী ও দুর্বৃত্ত ব্যক্তির খামখেয়ালের ওপর নির্ভরশীল হয়ে চলতে পারে না। দু’দেশের নীতি নির্ধারকদেরকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে মাফিয়ামুক্ত সুষম বাণিজ্যের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সিন্ডিকেটমুক্ত সহজ সুষম বাণিজ্য নিশ্চিত করতে হলে কমলাপুর আইসিডির মতো শর্তহীন অবাধে সব রকম পণ্য রেলকার্গো ও কন্টেইনারে আমদানির বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।