তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের পাহাড়ি এলাকায় লেবু বাগানে সাথী ফসল হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে নাগা মরিচ চাষ। তুলনামূলক কম বিনিয়োগ ও পরিশ্রমে ভালো ফলন এবং বাজারে দাম বেশি পাওয়ায় অনেকে ঝুঁকছেন নাগা মরিচ চাষে। জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার মাটি নাগা মরিচ চাষের উপযুক্ত হওয়ায় চাষীদের উদ্বুদ্ধ করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সিলেটের মধ্যে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে নাগা মরিচের সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। ঝালের জন্য বিখ্যাত সিলেটের নাগা মরিচ অঞ্চল ভেদে বোম্বাই মরিচ, ফোটকা মরিচ বা কামরাঙা মরিচ নামেও পরিচিত। ২০০৭ সালে গিনেস বুকে নাগা মরিচকে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝাল মরিচ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
সম্প্রতি শ্রীমঙ্গলের কয়েকটি লেবু বাগানে গিয়ে দেখা যায়, বাগানে লেবু গাছের সঙ্গে ছোট ছোট সবুজ নাগা মরিচ গাছে লাল সবুজ মরিচ ঝুলছে। বাগানের ফাঁকা জায়গা এবং টিলার নিচে সমতল জায়গায়ও চাষ করা হয়েছে এ ফসল। লেবু গাছের সঙ্গে সহজে এ ফসল চাষ করা যায় বলে প্রায় প্রতিটি লেবু বাগানে চাষ হচ্ছে সুগন্ধি নাগা মরিচের।
চাষীরা জানান, বর্তমানে শ্রীমঙ্গলের কয়েক শত লেবু বাগানে সাথী ফসল হিসেবে নাগা মরিচ চাষ হচ্ছে। চারা কিনে গাছ লাগানোর পর খুব বেশি যত্ন নিতে হয় না এ ফসলের। লেবু গাছের নিচে যে সার-গোবর দেয়া হয় তা থেকেই খাদ্যরস গ্রহণ করে মরিচ গাছ। সাধারণ মাঘ-ফাল্গুন মাসে সাথী ফসল হিসেবে নাগা মরিচের চারা রোপণ করা হয়। এতে একই সঙ্গে লেবু বাগানেরও যত্ন নেয়া যায়। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে গাছে মরিচ আসতে শুরু করে। ভাদ্র-আশ্বিন মাস পর্যন্ত ফসলের ভরা মৌসুম। তবে সারা বছরই কম-বেশি মরিচ আসে গাছে। একবার গাছ লাগালে প্রায় দেড় বছর ফলন পাওয়া যায়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে প্রতিটি গাছ থেকে ৫০০-১০০০ হাজার মরিচ পাওয়া যায়। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখানকার নাগা মরিচ সরবরাহ হচ্ছে। চাহিদা বাড়ায় এ বছর নাগা মরিচের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। দাম বাড়ায় নতুন করে এ মরিচ চাষে যুক্ত হচ্ছেন অনেকে।
কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান লাগোয়া জমি ইজারা নিয়ে লেবু বাগান করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জানান, লেবু বাগানের ভেতর প্রথমে শখ করে কিছু নাগা মরিচ গাছ রোপণ করা হয়। ফসলের আকার ও ফলন ভালো হওয়ায় পরে বাণিজ্যিকভাবে মরিচ চাষ করছেন তিনি। বর্তমানে তার বাগানে কয়েক হাজার নাগা মরিচের গাছ রয়েছে। প্রতিটি ছোট আকারের মরিচ বর্তমান বাজারে দুই-আড়াই টাকা এবং বড় আকারের মরিচ ৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার লিটন আহমেদ জানান, তার ৪০ একরের লেবু বাগানে গত বছর কয়েক হাজার নাগা মরিচের গাছ রোপণ করেন। মাস কয়েক পর গাছে মরিচ ধরতে শুরু করে। প্রথম দিকে সপ্তাহে ৩০ হাজার মরিচ বিক্রি করেছেন। তবে বর্তমানে গাছগুলো জীবনচক্রের প্রান্তিক অবস্থায় চলে আসায় ফলন কিছুটা কমেছে। প্রতি সপ্তাহে ছয়-সাত হাজার মরিচ বিক্রি করা যাচ্ছে। আড়াই টাকা থেকে তিন টাকায় প্রতিটি মরিচ বিক্রি হচ্ছে। আগামী বছর নতুন চারা রোপণের কথা জানান তিনি।
চাষী কাজল রায় জানান, প্রতিদিন তিনি প্রায় চার হাজার নাগা মরিচ সরবরাহ করে গড়ে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। মাস শেষে খরচ বাদে তার লাখ টাকা আয় হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি বছর নাগা মরিচের জোগান কিছুটা কমেছে। আর চাহিদা বাড়ায় গত বছরের তুলনায় দাম বেড়েছে চার-পাঁচ গুণ। দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো বিদেশেও যাচ্ছে এ মরিচ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত সিলেটীরা বিভিন্ন উপায়ে নাগা মরিচ দেশ থেকে নিয়ে যান। অনেকে আবার উপহার হিসেবেও পাঠান।
জেলার মধ্যে নাগা মরিচের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার শ্রীমঙ্গল। এ বাজারের আড়তদার হাসেম আলী জানান, বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকাররা এখান থেকে নাগা মরিচ কিনে নিয়ে যান। শ্রীমঙ্গলে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টাকার নাগা মরিচ বিক্রি হয়। বর্তমানে চাহিদা বেশি থাকায় দামও বেশি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, মৌলভীবাজারের পাহাড়ের টিলা নাগা মরিচ চাষের সম্পূর্ণ উপযোগী। এখানে সোলানেসি, ক্যাপসিকাম ও ক্যাপসিকাম চাইনিজ জাতের নাগা মরিচ চাষ হচ্ছে। শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমে বাণিজ্যিকভাবে এ ফসল চাষ করা যায়। বাণ্যিজ্যিকভাবে আবাদ করলে জমি তৈরি করে দুই থেকে আড়াই ফুট দূরে লাইন করে প্রয়োজনীয় জৈব রাসায়নিক সার দিয়ে গর্তে চারা রোপণ করতে হয়। সারের পরিমাণ অনেকটা সাধারণ মরিচের মতো। জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না। চারা লাগানোর দুই মাস পর থেকেই ফুল আসে। ফুল আসার এক মাসের মধ্যে খাবার উপযোগী হয়ে উঠে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ফসলটি অধিক পরিমাণে উৎপাদন হচ্ছে। এ বছর উপজেলায় ৯৫ হেক্টর জমিতে নাগা মরিচ চাষ হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সামছুউদ্দিন আহমেদ জানান, কৃষি বিভাগের কাছে তথ্যনুসারে জেলায় ১০০ হেক্টর জমিতে নাগা মরিচ চাষ হয়েছে। তবে বাস্তবে তা অনেক বেশি। কারণ লেবু বাগান, আনারস বাগান, চা বাগানের পাশাপাশি অনেকে এ মরিচ চাষ করেন। সরকার থেকে কোনো প্রকল্প না করায় কৃষি বিভাগ নাগা চাষীদের পাশে সেভাবে দাঁড়াতে পারছে না। তবে মৌখিকভাবে যতটা সম্ভব তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে।