আমি একজন প্রবাসী, আমি জানি আমার দেশের মেহনতি মানুষগুলো কি পরিমান কষ্ট করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন! নিজ পরিবারের জন্য, দেশের জন্য , পরিবারের সন্তানটির মুখে হাসি ফুটানোর জন্য আজ তারা নিজ জীবনকে উৎসর্গ করে প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছেন। নিজ দেশে নিজের আত্মসম্মান সহ ভালো কোন চাকরি, ব্যবসা দিয়ে দিন চালাতে না পেরেই আজ তারা বিদেশী জীবন বেছে নিয়েছে। তারা পরিবারের বাহিরের মানুষটির কাছে সামান্য সম্মান পাওয়ার জন্যই আজ এ কষ্টের পথ বেছে নিয়েছে। হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধারা আজ বিভিন্ন দেশে চাকরি করছে। যেই চাকরিটি আত্বসম্মানের ভয়ে নিজ দেশে করতে পারছেননা! তার চাইতেও কঠিন চাকরি বিদেশের মাটিতে করে পরিবারের পাশে মানবতার খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রবাসী ভাইয়েরা।
বহু প্রবাসী নিজের জীবনকে বিলিয়ে তার সন্তানকে পড়াশুনা করাচ্ছে। নিজ মেয়েকে সঠিক পাত্রে পাত্রস্থ করার জন্য নিজের পরনের কাপড় না কিনে মেয়ের জন্য ভালো জামা কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। অনেকে তার বাবা মা, সংসারের ভাই বোন, স্ত্রীর পিছনে জীবনের সমগ্র ইনকাম খরচ করে জীবনের শেষ সময়ে খালি হাতে দেশে ফিরে যাচ্ছে!
বিদেশ উন্নত তাই মানুষ মনে করে যে,আমাদের ভাইয়েরা মনে হয় কত কি করে ফেলেছে? তারা হয়ত কোটি কোটি টাকা ইনকাম করে চলেছেন! আরো কত কি ! কিন্তু সত্যিকার চিত্র হচ্ছে বিদেশ উন্নত হচ্ছে কিন্তু আমাদের প্রবাসী ভাইদের কোনই উন্নতি হয়নি। ওদের কান্নার আওয়াজ চার দেয়ালের মাঝেই চাপা পরে আছে।আমার ভাইয়েরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জন মানুষের কল্যানে জীবনকে বিলায়ে দিচ্ছেন। ঠিকমতো কারো কাছ থেকে সঠিক কোন পরামর্শ বা উপকার থেকেও উপেক্ষিত আমার দেশের প্রবাসী ভাইয়েরা।
বিদেশের মাটিতে যাওয়ার সময়ও পরিবারের থেকে ধার দেনা করে বিদেশে পারি জমাচ্ছেন খেটে খাওয়া মানুষগুলো। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে পরিবারের খরচ পাঠানোর পরে নিয়মিত ভিসা পাসপোর্ট রেনিউ পর্যন্ত করাতে হিমশিম খেতে হয় প্রবাসীদের।দালালের খপ্পরে পরে এক সময়ে ভিসা পাসপোর্ট সবই হারাতে হয়। আবার আমাদের এম্বাসির পক্ষ থেকেও সঠিক সময়ে সঠিকভাবে সহযোগীতা না পাওয়ায় ভুক্তভোগীর স্বীকার হতে হচ্ছে সাধারন প্রবাসীদের।
পরোক্ষনেই আবার একদল মানবরুপি প্রভাবশালী মহল এই প্রবাসীদের নিয়েই বিভিন্ন উপায়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় বানাচ্ছেন। প্রবাসীদেরকে বিক্রি করেই আজ তারা তাদের সামাজিক স্টেটাস বৃদ্ধি করছেন! কেউ কেউ আবার বিভিন্ন দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতা বনে গিয়েছেন।কিন্তু এতোসব অপকর্মেও প্রবাসীরা কাউকে পক্ষ প্রতিপক্ষ ভাবছেননা। প্রবাসীরা সব সময়েই নিরপেক্ষ নিরিহ হিসেবে দিন যাপন করছেন! প্রবাসীরা নিজ কর্মে অর্থ কামাই করে পরিবার ও দেশের সম্মান সমুন্নত করে চলেছেন।
কিন্তু প্রবাসীদের নিরবতাকে পুজি করে একদল মানুষ যখন আজ তাদেরকে জঙ্গলের সাথে তুলনা করে! প্রবাসীদেরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নারী, মদ, জুয়ায় টাকা নষ্ট করছে বলে তোহমত দেয়া হয়!! তখন সত্যিই একজন প্রবাসী হয়ে চুপ থাকা কোন ভদ্র, দেশপ্রেমিক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমিও পারিনি চুপ থাকতে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের উন্নয়নের সিংহভাগই হয়েছে আমার প্রবাসীর টাকায়। প্রবাসীকেই আমারা আমাদের স্বার্থে বলি রেমিট্যান্স যোদ্ধা! অথচ বহু ভূয়া যোদ্ধারা দেশটাকে লুটে পুঁটে খাচ্ছে সেখানে আমার প্রাবাসী ভাইয়েরা রেমিট্যান্স যোদ্ধা হয়েও উপেক্ষিত সবসময়।
আমার প্রবাসী ভাইয়েরা দেশে বিদেশে সব যায়গায় উপেক্ষিত! তারা বিদেশেও যেমনি কষ্ট করে জীবন পরিচালনা করছেন,আবার দেশে গেলেও যথাযথ সম্মান থেকে তারা উপেক্ষিত। বহু কষ্ট করে টাকা জমিয়ে ১০/১২ বছর পরে দেশে যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টের কর্মকর্তা কর্মচারীদের চোখ রাঙানী সহ্য করে মেনে নিতে হয়। অনেকে তার শেষ সম্বল ব্যাগ লাগেসটি পর্যন্ত খুঁজে পাননা। এয়ারপোর্ট এ ই চুরি হয়ে যায় প্রবাসীর সম্বলটুকু। আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার প্রবাসীর লাশ মর্গে পড়ে আছে কিন্তু কেউ নেই তাদেরকে উদ্ধার করে দেশে পাঠানোর মতো ব্যাবস্থা করার! জীবন থাকতেও প্রবাসী ভাইটি ছিলো উপেক্ষিত, আবার মৃত্যুর পরেও সীমাহীন অবজ্ঞা, অবহেলায় লাশগুলো পড়ে আছে মর্গের ফ্লোরে। এইতো প্রাবাসীর জীবন! এইতো তাদের সম্মান!
আমার দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা সেবা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু আমরা কি ৫০ বছরে তা সত্যিই অর্জন করতে পেরেছি?? না পারিনি। হা পেরেছে কিছু মানুষ!যারা কিছু নাই থেকেও আজ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। যারা বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পরিচয় পরিবর্তন করে বাড়ী, গাড়ী , দেশ বিদেশে সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছেন। কিন্ত আমার সহজ সরল প্রবাসী ভাইয়েরা কিছুই করতে পারেনি জীবনের শেষ দিনটিতেও।
প্রবাসীরা আপনাদের কাছে কিছু চায়না, আপনারা প্রবাসীদের জন্য কিছু দিতেও পারবেননা।প্রবাসীরা নিজ পায়ে হালাল উপায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। প্রবাসীরা বাংলাদেশের সম্মান উঁচু করে বিশ্বের দরবারে দেখিয়ে দিতে চায়, প্রবাসীরা ন্যায়ের পথে চলে পরিবারে শান্তি চায়।
পরিশেষে বলতে চাই, গলা মোটা করে প্রবাসীদের বিরোধীতা না করে আসুন, আমার ভাইদেরকে সম্মান করে কথা বলি। সম্মানটুকু কেড়ে নেয়ার অধিকার আপনার আমার কারোরই নাই।সম্মান দিলে সম্মান পাওয়া যায়। কোটি প্রবাসী আমাদের সম্পদ, আসুন এই সম্পদ রক্ষায় তাদের পাশে দাঁড়াই। তাদেরকে সম্মান করি। তাহলেই বাঁচবে দেশ, বাচবে মানবতা। আল্লাহ আমাদের সুমতি দান করুন। আমিন।
লেখকঃ ড. ফয়জুল হক,
আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ার পোষ্ট গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট সোসাইটির ও বাংলাদেশ স্টুডেন্ট ইউনিয়ন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট,ডক্টর ফয়জুল হক ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা।