প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মুজিববর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং সামনে রোজা ও ঈদ। এই রোজা-ঈদ সবকিছু সামনে রেখে এই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র আপনাদেরকে উপহার দিয়ে গেলাম।’
আজ সোমবার পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের উদ্বোধন ঘোষণা করে এ কথা বলেন তিনি।
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী সশরীরে কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন।
বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই মার্চ মাস আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের মাস, অনেক ত্যাগের মাস। আজকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে আমরা আলো জ্বালাতে পারলাম। এটাই সবচেয়ে বড় কথা, আমরা আলোকিত করতে পেরেছি প্রতিটি ঘর।’
এই মহেন্দ্রক্ষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় ৪ নেতা, ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে স্মরণ করে এবং সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের আত্মত্যাগ আমাদের এনে দিয়েছে স্বাধীনতা। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে গিয়ে জাতির পিতা যে উদ্যোগগুলো নিয়েছিলেন, মাত্র ৯ মাসের মধ্যে আমাদের একটি সংবিধান দেন। সেই সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদেই তিনি সারা বাংলাদেশে, অর্থাৎ গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত যাতে উন্নত হয় সেই নির্দেশনা দিয়েছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটা দেশের উন্নতির জন্য বিদ্যুতায়নটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই আমাদের সংবিধানেও পুরো পল্লী অঞ্চলের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতটা কত গুরুত্বপূর্ণ সেটাও সেখানে উল্লেখ করা রয়েছে। তা ছাড়া, ৭৫ সালের জুলাই মাসে তিনি যখন পানি ও বিদ্যুৎ প্রকৌশলী সম্মেলনে ভাষণ দেন, তখন সেখানে বলেছিলেন, “বিদ্যুৎ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। কিন্তু দেশের জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ লোক যে শহরের অধিবাসী সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও শতকরা ৮৫ জনের বাসস্থান গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করিতে হইবে। ইহার ফলে গ্রাম বাংলার সর্বক্ষেত্রে উন্নতি হইবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ চালু করিতে পারিলে কয়েক বছরের মধ্যে আর বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানি করিতে হইবে না।”‘
‘জাতির পিতা একটা কথা বলতেন যে, ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। কারো কাছে হাত পেতে না, নিজের পায়ে দাঁড়ানো। নিজের ক্ষুধার অন্ন নিজেরা উৎপাদন করব,’ যোগ করেন তিনি।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের উন্নয়ন কীভাবে হবে, বিদেশি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে জাতির পিতার জবাব তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার মাটি আছে, মানুষ আছে। এই মাটি, মানুষ দিয়েই আমি বাংলাদেশকে উন্নত করব।” কত স্বপ্ন ছিল, কত আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেভাবে তিনি পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। পল্লী বিদ্যুতায়নকে কত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নিল আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৯৬ সালে সরকার গঠন করি। বিদ্যুতের জন্য হাহাকার। সামান্য কিছু মানুষ বিদ্যুৎ পায়, গ্রামে গ্রামে তো বিদ্যুৎ নেই-ই। আমরা উদ্যোগ নিলাম, শুধু সরকারি না, বেসরকারি খাতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করব এবং মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছাব। যেখানে মাত্র ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেয়েছিলাম, ৫ বছরের মধ্যেই আমরা ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হলাম। দুর্ভাগ্য, আবার ২০০১ এ সরকারে আসতে পারিনি। ২০০৮ এর নির্বাচনের পর যখন ২০০৯ এ সরকার গঠন করি, তখন দেখি ৪ হাজার ৩০০ থেকে কমে ৩ হাজার ২০০ তে নেমে গেছে বিদ্যুৎ। মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু বাংলাদেশ সব সময় পিছিয়ে যাচ্ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত যারা সরকারে ছিল, এ দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কোনো আন্তরিকতাই তাদের ছিল না। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য এ দেশের মানুষের।’
তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে ২০২২ সাল। এই দীর্ঘ সময় সরকারে থাকতে পেরেছি, সে জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। ভোট দিয়ে আমাদেরকে তারা নির্বাচিত করেছেন। এই ১৩ বছর একটানা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অব্যাহত রয়েছে। এর মাঝে ঝড়-ঝঞ্ঝা অনেক এসেছে, বাধা অনেক এসেছে। কিন্তু সে বাধা আমরা অতিক্রম করছি।’
‘ওয়াদা করেছিলাম, প্রতিটি মানুষের ঘর আলোকিত করব, প্রতিটি মানুষ আলোকিত হবে। আলোর পথে আমরা যাত্রা শুরু করেছি। আজকের দিনটা সেই আলোর পথে যাত্রা শুরু যে সফল হয়েছে, সেই দিন। আপনাদের সবাইকে সে জন্য ধন্যবাদ জানাই।’
‘গবেষণার মাধ্যমে আমরা লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান বীজ উৎপাদনে সফল হয়েছি। এই দক্ষিণাঞ্চল অবহেলিত ছিল। কিন্তু আমরা বীজ গবেষণা কেন্দ্র করে দিয়েছি। এই অঞ্চলে আজকে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর থেকে শুরু করে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ চলছে। যেসব এলাকা এক সময় ঝড় জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হতো; মানুষের একটা মাত্র ফসল, তাও নষ্ট হলে দুর্ভিক্ষে পরতে হতো; আল্লাহর রহমতে আর সেই দুর্ভিক্ষ হবে না, আর মানুষের সেই কষ্ট থাকবে না। মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবে, উন্নত জীবন পাবে।’
‘তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি আমরা রিনিউয়েবল এনার্জি, অর্থাৎ সোলার প্যানেল করছি। আপনারা জানেন, ইতোমধ্যেই আমরা রাঙাবালি, নিঝুম দ্বীপ, সন্দীপসহ বিভিন্ন এলাকায় নদীর নিচ দিয়ে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছি। যেখানে বিদ্যুতের গ্রিড লাইন নেই, সেখানে সোলার প্যানেল করে দিচ্ছি।’
‘কোনো ঘর অন্ধকারে থাকবে না, প্রতিটি ঘর আলোকিত হবে, এটাই তো আমাদের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’