কুয়েতে ৬ জুন রাতে আটকের পর সাংসদ শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলের দপ্তরের সিসিটিভি, দলিলপত্র আর গাড়িতে থাকা চেকবই থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো শহিদ ইসলামের মুঠোফোন। ওই মুঠোফোনেই কুয়েতের সাংসদসহ স্বরাষ্ট্র, সমাজকল্যাণসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের লোকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা লক্ষ্মীপুর-২ আসনের ওই স্বতন্ত্র সাংসদকে অনৈতিক সব কাজে মদদ দিয়েছেন।
কুয়েতের সিআইডি কর্মকর্তারা ওই মুঠোফোনের সূত্র ধরে সাবেক ও বর্তমান পাঁচ সাংসদ, স্বরাষ্ট্র ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্তৃপক্ষের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কয়েকজন ব্যবসায়ীর নাম জানতে পেরেছেন। তাঁদের সবাই শহিদ ইসলামের কাছ থেকে নগদ অর্থ ও চেকের মাধ্যমে ঘুষ এবং উপহার নিয়ে তাঁকে নানাভাবে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন।
তদন্ত কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আরবি দৈনিক আল সিয়াসাহ ও ইংরেজি দৈনিক আরব টাইমস গতকাল সোমবার এ খবর জানায়।
আরবি দৈনিক আল কাবাসের খবরে বলা হয়, কুয়েতের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ শহিদ ইসলামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের যে দুটি চুক্তি নবায়ন করেছিল, তার একটি বাতিল করতে যাচ্ছে। যেহেতু বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতার জন্য ওই কাজ দেওয়া হয়েছিল, তাই কাজটি অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। তবে গত এপ্রিলে অন্য আরেকটি কাজের যে চুক্তিপত্র বাড়ানো হয়েছিল, এর পরিণতি কী হবে, তা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট করেনি।
উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাস আল সালেহ গত রোববার বলেছেন, সরকার ভিসা–বাণিজ্যের মতো সংক্রামক ব্যাধি দূর করতে বদ্ধপরিকর। ওই অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের সবার বিরুদ্ধে একই আইন প্রযোজ্য হবে।
শহিদ ইসলামের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাস আল সালেহ তাঁর মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করতে যাচ্ছেন। এরই মধ্যেই ‘অভিযুক্ত’ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তার সচিব শহিদ ইসলামের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে নগদ টাকা নেওয়ার বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।
আল সিয়াসাহ ও আরব টাইমস তদন্ত সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে জানিয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিযুক্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। ওই ব্যাংক হিসাবে ঘুষের টাকা নগদ ও চেকের মাধ্যমে জমা দেওয়া হতো। ওই কর্মকর্তার সচিব তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে নগদ ও চেকের মাধ্যমে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তদন্ত কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ যে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তিনি শহিদ ইসলামের জন্য ২৩ হাজারের বেশি কর্মীর এন্ট্রি ভিসার অনুমোদনে সহায়তা করেছিলেন। যদিও সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, ওই কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনের সময় বাংলাদেশের কর্মীদের নামে এন্ট্রি ভিসা অনুমোদন করতে পারবেন না।
শহিদ ইসলামের মুঠোফোনে তদন্ত কর্মকর্তারা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক আন্ডার সেক্রেটারিসহ বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার ছবি ও ভিডিও পেয়েছেন। তাঁদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের সাংসদের মানব ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের বিষয়টিতে অনেকের যুক্ততার ফলে বিদেশি কর্মীদের বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা উঠেছে। এটি হলে বিদেশিদের নিয়োগের সংখ্যা কমানো, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ ও মিসরের লোকজনের জন্য পর্যটন ভিসা বন্ধের মতো বিষয়গুলো যুক্ত হতে পারে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে বাংলাদেশের সাংসদের আটকের বিষয়টি উত্তাপ ছড়াচ্ছে কুয়েতের রাজনৈতিক অঙ্গনে। কারণ, এ বছরের শেষের দিকে দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচন। আর নির্বাচনের কয়েক মাস আগে মানব পাচারে সাংসদদের যুক্ততার বিষয়টি এখন সবাই জেনে গেছেন। শহিদ ইসলামকে মদদ দেওয়ার অভিযোগে কুয়েতের বিচার এবং ধর্মমন্ত্রী ফাহাদ মোহাম্মদ মহসিন আল আফাসি রোববার পার্লামেন্টের স্পিকার মারজুক আল ঘানেমকে চিঠি লিখেছেন। ওই চিঠিতে তিনি দুই সাংসদের প্রাধিকার প্রত্যাহারের জন্য ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
কুয়েতের সাংসদ থামের সাদ আল ধেফাইরি শহিদ ইসলামকে মদদ দেওয়া তিন সাংসদের নাম প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। আল ধেফাইরি বিচারমন্ত্রী মহসিন আল আফাসির কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, পাবলিক প্রসিকিউশনের দপ্তর থেকে ১ মে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছিল, সাংসদেরা শহিদ ইসলামকে মানব ও অবৈধ মুদ্রা পাচারে মদদ দিয়েছেন। তাই তাঁদের প্রাধিকার প্রত্যাহার করা হোক। কাজেই পাবলিক প্রসিকিউশনের দপ্তরের অভিযোগ সত্যি হলে অভিযুক্ত সাংসদদের নাম প্রকাশে বাধা কোথায়!
বাংলাদেশের সাংসদ শহিদ ইসলামকে ৬ জুন রাতে কুয়েত সিটির মুশরিফ এলাকার বাসা থেকে আটক করে সিআইডি। এরপর রিমান্ড শেষে তাঁকে কুয়েতের কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। যদিও একাধিকবার জামিনের আবেদন করে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁর আইনজীবী। আগামী ৬ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের শুনানির কথা রয়েছে।
উৎসঃ প্রথম আলো