‘লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার পরে আমি পানির ভেতরে ছিলাম। পরে আল্লাহ আস্তে আস্তে আমাকে একটি জায়গায় নিয়ে আসে, যেখানে কোনো পানি ছিল না। পা পর্যন্ত একটু পানি ছিল, আমি সেই পানি দিয়ে ওজু করেছি, এরপর দোয়া-দুরুদ পড়েছি।’ গতকাল মঙ্গলবার মিটফোর্ড হাসপাতালের বিছানায় বসে লঞ্চডুবির ১৩ ঘণ্টা পর উদ্ধার হওয়া সুমন বেপারী এভাবেই বলছিলেন বেঁচে যাওয়ার অভিজ্ঞতা।
তবে তার কথা-বার্তার মধ্যে বেশ অসংলগ্নতা রয়েছে। চিকিত্সকরা বলছেন, মানসিক ৃট্রমার কারণে তিনি হয়তো সবকিছু ঠিকভাবে বলতে পারছেন না। এ নিয়ে গতকাল দিনভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের আলোচনা হয়েছে। গতকাল বিকালে তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তিনি বাড়ি ফিরে গেছেন।
ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দেবাশিষ বর্ধন বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, উদ্ধার হওয়া সুমন বেপারী সম্ভবত ইঞ্জিন রুমে ছিলেন। সাধারণত ইঞ্জিন রুম এয়ারটাইট হওয়ার কারণে সেখানে পানি প্রবেশ করে না। সোমবার রাত সোয়া ১০টার দিকে কুশন পদ্ধতি ব্যবহার করে জাহাজ ভাসানোর চেষ্টা করা হলে সম্ভবত ইঞ্জিন রুম খুলে যায়। সে সময় তিনি ঐ রুম থেকে বের হয়ে আসেন এবং উদ্ধারকর্মীরা তাকে উদ্ধার করেন।’
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লঞ্চে এয়ারটাইট রুমে যে কেউ ১৪-১৫ ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে। সুমন হয়তো এয়ারটাইট রুমে আটকা পড়েছিল।’
সুমন বলছিলেন, ‘লঞ্চ যখন ডোবে, তখন আমি ঘুমাচ্ছিলাম। লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার সময় ঘুম ভাঙে। শুধু বুঝতে পারলাম, লঞ্চটি ধাক্কা খাইলো। আর কিছু খেয়াল নাই। কিসের মধ্যে ছিলাম আল্লাহ জানেন, তবে ভেতরে এক জায়গায় খাঁড়ায় ছিলাম রড ধইরা।’ সুমনের ভাষ্য, লঞ্চটি সোমবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসে, সে সময় তিনি ইঞ্জিন রুমের সাইডে বসা ছিলেন। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামে তার বাড়ি। তিনি একজন ফল ব্যবসায়ী। সদরঘাটের বাদামতলী ফলের আড়তেই ব্যবসা। ব্যবসার কাজেই ঢাকায় ফিরছিলেন। তিনি রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ছিলেন। তার অবস্থা স্থিতিশীল বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে সুমন বলেন, ‘আমার কাছে মনে হইলো ১০ মিনিট ছিলাম, আল্লাহ যে ক্যামনে ১২/১৩ ঘণ্টা পার কইরা দিল বলতে পারি না। আমি ভেতরে কিসের মধ্যে ছিলাম, কিচ্ছু বুঝতে পারি নাই, তবে পানির তলে ছিলাম এইটুক জানি। আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করিনি। চেষ্টা করলে হয়তো বের হতে পারতাম, আবার নাও পারতাম। তাই আমি সেখানেই ছিলাম। আমার যতদূর মনে আছে, লঞ্চের ইঞ্জিন রুমের পাশের একটি রুমে ছিলাম এবং লঞ্চের চালককে আমার অদক্ষ বলেই মনে হয়েছে।’
কিভাবে বের হলেন জানতে চাইলে সুমন বলেন, ‘আল্লাহ বাইর কইরা নিয়ে আসছে। বের হওয়ার সময় কিচ্ছু বুঝি নাই। বের হওয়ার পর আমারে উদ্ধার কইরা নিয়ে আসছে। পানির মধ্যে যখন ছিলাম, তখন সাঁতার কাটার ফোম দেখছিলাম চোখের সামনে, হাতরায় নিতে পারতেছিলাম না, পরে লোহার রড ধরে বসে ছিলাম।’ নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল কি-না জানতে চাইলে সুমন বেপারী বলেন, ‘নিঃশ্বাস আল্লাহ দিসে। না দিলে তো মইরাই যাইতাম। ওপরে যখন উঠি, তখন কিছুই বুঝতে পারি নাই, ক্যামনে উঠলাম কীভাবে উঠলাম।’
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম এ সাত্তার সরকারের অধীনে চিকিত্সা হচ্ছে সুমনের। সাত্তার সরকার জানান, সুমনের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল আছে। তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছেন, কথাবার্তা বলছেন। আমরা কিছু টেস্ট করব, তারপর সিদ্ধান্ত নেব।’
মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রাশীদ উন নবী বলেন, ‘সুমন বেপারীর শারীরিক অবস্থা এখন অনেক ভালো। আপাতত তিনি আশঙ্কামুক্ত। তিনি সবার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা বলছেন।’
নৌপুলিশের সদরঘাট থানার ওসি রেজাউল করিম বলেন, মঙ্গলবার সকালে নৌ পুলিশ হাসপাতালে গিয়ে সুমনের সঙ্গে কথা বলেছেন। সুমন পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি লঞ্চের মধ্যে আটকা পড়েন। রাতে বেরিয়ে আসেন।
সোমবার সকালে বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চডুবির ১৩ ঘণ্টা পর সুমনকে জীবিত উদ্ধার করা হয় বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস।
উৎসঃ ইত্তেফাক