করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা নিয়েই চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। উপসর্গ নিয়ে অসংখ্য মানুষ অপেক্ষা করছেন টেস্টের জন্য। কিন্তু হটলাইনে যোগাযোগের এক সপ্তাহেও নমুনা সংগ্রহ করতে আসছে না। নমুনা নিয়ে গিয়ে ১৫ দিন পার হলেও মিলছে না রিপোর্ট। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর পজিটিভ হলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে কেউ খোঁজও নেন না। আক্রান্ত হওয়ার ২০ দিন পর কোনো রকম উপসর্গ না থাকলেও পুনরায় টেস্ট করার ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছেন রোগীরা। আবার যা নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে তার তিন ভাগের এক ভাগ পরীক্ষা করা হচ্ছে। এমন অবস্থার মধ্যে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি সক্ষমতা থাকা বেসরকারি হাসপাতাল ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে করোনা পরীক্ষা ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে। গত ২১ মে টেকনিক্যাল কমিটি এই সুপারিশ করে। কিন্তু এক মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, এ ব্যাপারে সুষ্ঠু নীতিমালা করে দ্রুত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলেই কার্যকর হবে।
টানা চার দিন বিনা চিকিত্সায় থাকার পর গত ২৯ এপ্রিল মারা যান পুলিশ সদস্য মো. জসিম উদ্দিন। মৃত্যুর পর জানা গেল তিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত ছিলেন, যদিও এ পুলিশ সদস্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল ২৫ এপ্রিল। জসিম উদ্দিনের পরিবারের অভিযোগ, পরীক্ষার ফল দ্রুত পাওয়া না যাওয়ায় বিনা চিকিত্সায় মরতে হয়েছে তাকে। শুধু এ পুলিশ সদস্য নন, অনেকের ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটছে। কেউ পরীক্ষার ফল পেতে দেরি হওয়ায় চিকিত্সার অভাবে মারা যাচ্ছেন, আবার অনেকেই কয়েক দিন ঘুরেও পরীক্ষা করাতে পারছেন না। কেউবা শনাক্ত কি-না নিশ্চিত না হওয়ায় নিজের অজান্তে অন্যের মধ্যে ছড়াচ্ছেন করোনা ভাইরাস। অথচ নমুনা সংগ্রহের অনেক বুথে নমুনা সংগ্রহ আগের চেয়ে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. খান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বেসরকারি হাসপাতাল ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে করোনা পরীক্ষা উন্মুক্ত করা যেতে পারে। জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়েছে।
স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, করোনা পরীক্ষার জন্য বেসরকারি হাসপাতাল ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উন্মুক্ত করা যেতে পারে। তবে যাতে মনোপলি ব্যবসা না হয় সেজন্য ফি নির্ধারণ করে দিতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশে করোনা পরীক্ষার অবস্থা নিয়ে চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক টিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, ‘দ্রুত টেস্ট আর দ্রুত পরীক্ষার ফল পাওয়া নিশ্চিত করেই রোধ করতে হবে সংক্রমণের পথ।’ সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দেশে কিট সংকটের কথা বলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবের সংখ্যা বাড়ালেও এখন পর্যন্ত সব ল্যাবে পর্যাপ্ত কিটের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিজের কাছেই পর্যাপ্ত কিটের সংস্থান এখন নেই। এর মধ্যে দেশের একাধিক করোনা ল্যাব জানিয়েছে, কিট না থাকায় পরীক্ষা করতে পারছে না তারা।
এদিকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি দেখা দিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিট দিয়ে দেশে শুরু হয় করোনা পরীক্ষা। সংস্থাটি বিভিন্ন সময় বেশ কিছু কিট উপহার দিয়েছে বাংলাদেশকে। কিট উপহার পাওয়া গেছে চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও। এর বাইরে একটি প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরকে কিট সরবরাহ করে আসছিল। কিন্তু সময়মতো কিট আনতে না পারা ও আনার পরে ভ্যালিডেট করতে না পারায় তাদের অনেকের ওয়ার্ক অর্ডার বাতিল করা হয়।
দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা আরো বলেন, শুরু থেকেই করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার ব্যাপারে অনীহা দেখিয়ে আসছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। সেই কারণে তারা সময়মতো টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দেয়নি। ভবিষ্যতে করোনা কী রূপ নিতে পারে, সেই ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। তারা বলেন, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের একার পক্ষে করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব না। সারা বিশ্বেই এভাবে হচ্ছে। সারাদেশে ৩৬টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি যেসব হাসপাতালে পিসিআর মেশিন আছে, সেসব হাসপাতালেও পরীক্ষা দ্রুত চালু করতে হবে।